গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের ইফতার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০১৯, ৪:১১ অপরাহ্ণ
রায়হান আহমদ:
ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘুম ভাঙে। জীবিকার তাগিদে প্রতিটা দিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয় গ্রামের কর্মঠ মানুষদের। কিন্তু রমজান এলে বদলে যায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারের দৈনিক রুটিন। দিনের বেলা খাবারের আয়োজন নেই। তবে দুপুরের দিকেই চুলোয় আগুন দেওয়া শুরু হয় মুসলিম পরিবারে। বাড়ির মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নানা পদের সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার তৈরিতে।
শরবত, চানা বা ছোলা, বেগুনি, পিঁয়াজি, খিচুড়ি, ফিরনি, আখনীসহ নানা পদের ইফতার রান্না হয় সামর্থবান পরিবারগুলোতে। এরসাথে যুক্ত হয় বাজার থেকে কিনে আনা বাখরখানি, জিলাপি, ফলমূলের সঙ্গে বাহারী অনেক কিছু। কিন্তু যারা সামর্থহীন তাদের সাধ আর সাধ্যে ফারাক রমজানেও চোখে পড়ে। যাদের নূন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের পরিবারে সেই বাহারী আয়োজন তেমন চোখে পড়ে না। অভাবপিষ্ট পরিবারগুলোর ইফতারিতে অন্যতম আয়োজন মুড়ি, মুড়কী, সেমাই, ঝাউ আর সামান্য ছোলাভাজা অথবা কারো বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারের অংশ বিশেষ।
ইফতারকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ প্রকৃতিতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে পড়ন্ত বিকেলে। এরমধ্যে অন্যতম ইফতার সামগ্রী আদান-প্রদান। গ্রামের মা, বোন, স্ত্রী, চাচীরা নিজেদের তৈরী হরেক রকম ইফতার প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি না করে খেতেই পারেন না। একটা থালার মধ্যে ইফতার সামগ্রী নিয়ে কাপড়ের আঁচল বা কাগজ দিয়ে ঢেকে পাশের ঘর কিংবা প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করার দৃশ্য গ্রামাঞ্চলে হরদম দেখা যায়। শিশুরা রোজা রাখে না কিন্তু ঘরে ব্যতিক্রমী খাবার তৈরি হওয়াতে তারাও আনন্দিত হয়।
রোজাদারকে ইফতার করানো সওয়াবের কাজ। গ্রামের মসজিদে বিভিন্ন বাড়ি থেকে পালাক্রমে ইফতারি পাঠানো হয়। কেউ কেউ নিজের ঘরের তৈরি দু’একটি আইটেম নিয়ে আসেন। অনেকে নিজ বাড়িতেই বন্ধু-বান্ধব, আত্মিয়-স্বজন অথবা প্রতিবেশীদের নিয়ে ঘটা করে ইফতারির আয়োজন করেন। অনেকে গরীব, দুখী, এতিমদের ইফতার করান নিজ উদ্যোগে। ইদানিং চেয়ার-টেবিলে বসে ইফতারের প্রচলন শুরু হলেও ধনী-গরিব সবাই সারিবেঁধে বসে একসাথে ইফতার করাটা এখনো গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ভাবা হয়। বাড়ির সবাইকে নিয়ে একসাথে ইফতার করার মজাটাই আলাদা। ইফতারের কয়েক মিনিট আগে ঘরের মেঝেতে মাদুর/শীতলপাটি বিছিয়ে রাখা হয় ইফতার সামগ্রী। খাবার সামনে রেখে হারিকেন মৃদু আলোয় বসে তখন চলে ইফতারের ক্ষণগণনা। মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদু পরিবারের সবাই তখন একসাথে বসে। তারপরও গ্রামের কর্মব্যস্ত মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে ইফতার সারতে হয়। আবার কেউবা কাজের মাঝেই সারেন ইফতার। এদের মধ্যে কৃষক, দিনমজুর, ছোট্ট দোকানির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে প্রায়ই।
ইফতারি নিয়ে কোনো কোনো অঞ্চলে বিশেষ করে সিলেট বিভাগে একটি সামাজিক রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হয় ইফতারি। নতুন বিয়ে হলে তো কথাই নেই, প্রথম রোজাতেই ইফতারি পাঠাতে হয়। বিয়ের পর প্রথম ইফতারি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেয়া হয়। জামাই তার বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দেন। বাবার বাড়ির লোক দেখে গায়ের নতুন বঁধু তখন আনন্দে আত্মহারা। নতুন বধূঁর বাড়ি থেকে কী এলো তা দেখতেও প্রতিবেশীদের কৌতুহল চোখে পড়ার মতো। কার শ্বশুর বাড়ি থেকে কেমন ইফতার দেওয়া হলো তা নিয়েও রীতিমত আলোচনা শুরু হয় গ্রাম জুড়ে।
মসজিদের মাইকে আজান দিলে সবাই একসাথে ইফতারে অংশ নেওয়াটা রোজদারদের অন্যতম অনুসঙ্গ। ইফতারের সময়ের জন্য রোজাদাররা খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকেন। কখন আজান হবে অথবা কখন বাজবে সাইরেন। ইফতার সামগ্রী সামনে রেখে অপেক্ষার মুহূর্তটি দারুণ আনন্দের। যে কৃষক মাঠে কাজ করছেন তিনিও তখন জমিতেই ইফতার করেন অন্যদের সাথে। যে মজুর এইমাত্র বাড়ি ফিরছেন আজানের সাথে সাথে পাশের দোকান থেকে একগ্লাস পানিতেই সারছেন ইফতার।
সবকিছুর পড়েও গ্রামীণ ইফতারের যে প্রাণ-প্রাচুর্য্য তা দেখা যায় না শহরের আটতলা-দশতলার সমাজে। গ্রামীণ পরিবারগুলো রোজাদার কাউকে অভূক্ত রেখে কখনোই নিজের খাবার তুলে নেয় না। গ্রামীণ এই সংস্কৃতিই রোজার সংযমকে প্রকৃতভাবেই অর্থবহ করে তুলে।