ক্বীন ব্রিজ যেনো একের ভিতর পাচঁ !
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০১৭, ১০:১৩ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সিলেট শহরের কয়েকটি অন্যতম স্থাপনার কথা মনে পড়লে যে কয়টি নাম চোখে ভেসে উঠে তার মধ্যে ক্বীন ব্রিজ একটি।যুগ যুগ ধরে কালের শাক্ষি হয়ে সুরমা নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে কিন ব্রিজ। নগরীর একসময়ের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত কিন ব্রিজ প্রতিদিন চলাচল করে কয়েক হাজার মানুষ। ৮১বছরে পা দেয়া এই ব্রিজ যেনো সিলেটের অতীত ইতিহাসের সাথে মিশে আছে সগৌরবে। সুরমা নদীর সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের মাধ্যমে কিন ব্রিজ এলাকাকে বিনোদন এবং ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণের স্থান হিসেবে গড়ে তুলা হয়েছে।বিকেল হলে অগণিত দর্শনার্থী ভিড় জমায় সুরমা পাড়ে বাধানো রেলিংগেরা তিরে।
আসাম প্রদেশের গভর্ণর মাইকেল ক্বীন সিলেট সফরে আসার জন্য সুরমা নদীতে ব্রীজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ তখন আসামের সাথে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। ফলে, রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রীজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রীজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়।মাইকেল কিন এর সাথে মিলিয়ে ব্রিজের নাম রাখা হয় কিন ব্রিজ।এই ব্রীজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। ব্রীজ নির্মাণে তৎকালীন সময়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। স্টীলের তৈরী এই ব্রিজটির দৈর্ঘ্যে ৩৯৫মি:। সময়ের সাথে সাথে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে ২০০৬ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক পুনরায় ব্রিজটির মেরামতসহ নদী তীরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়। তাতে আকর্ষণ আরো বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগে কিন ব্রিজের নিচের সুরমাপাড়টি সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় সিরামিক ইট বিছানো হয়। সুন্দর আলোর সারি ও গাছপালায় জায়গাটি মনোরম। এখন বিকেল হওয়ার আগে থেকেই লোকজন এসে জড়ো হতে থাকে। বিশেষ করে বন্ধের দিনে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় কিন ব্রিজ এলাকা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ব্রীজের উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়, যা স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলী পার্টস দিয়ে মেরামত করা হয় ও হালকা যান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়।মুক্তিযোদ্ধের যেনো সাক্ষী হয়ে রইলো এই ব্রিজ।
ব্রিজের পাশেই সিলেটের আরো এক ঐতিহাসিক স্থাপনা আলী আমজদের ঘড়িঘর যেনো কিন ব্রিজের সৌন্দর্যের মাত্রা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিলো।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে এই প্রাচীন ঘড়িঘর বিধ্স্ত হয়। স্বাধীনতার পর সিলেট পৌরসভা ঘড়িটি মেরামতের মাধ্যমে সচল করলেও কিছুদিনের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে আলী আমজদের ঘড়ি মেরামত করে পুনরায় চালু করা হয়।
ঐতিহাসিক চাঁদিনী ঘাট,শত বছরের পুরোন সারদা হল এবং আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সিলেট সার্কিট হাউজ যেনো কিন ব্রিজ কে অন্য এক রুপ দিয়েছে।যানা গেছে ২০০৫ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উদ্যোগ বদলে দিয়েছিলো কিন ব্রিজ সংলগ্ন সুরমা নদির দুইকূলের চিত্র।সুরমার দুইকূল জুড়ে ৬০০ ফুট জায়গা নিয়ে গড়ে তুলা হয়েছে প্লাজা গার্ডেন।ফুটপাত ও রাস্তা প্রশস্ত করার ফলে কিন ব্রিজ এলাকা যেনো ভ্রমণ পিপাসুদের তীর্থস্থান।দূর থেকে দেখলে মনে হয় নদীর বুকে ভেসে আছে মামুলি একটি লঞ্চ। কিন্তু রাতের বেলা এর ভিন্ন চেহারা। বড় আকারের লঞ্চটির নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কারো নজর কাড়ে। তবে এটি লঞ্চ বা স্টিমার নয়, ভাসমান রেস্তোরাঁ।এটি সিলেটের একমাত্র ভাসমান রেস্তোরা।আর এই রেস্তোরার অবস্থান কিন ব্রিজের টিক নিছে।কিন ব্রিজ যেনো একের ভিতর পাচঁ।
সিলেটের আরো এক অনন্য স্থাপনা কাজির বাজার ব্রিজ।১৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণের মধ্যদিয়ে কিন ব্রিজ এলাকার যান চলাচল চাপ অনেক টাই কমে গেছে।আগের মতো এখন আর কিন ব্রিজে দর্শনার্থীদের ভিড় তেমন দেখা যায় না।ভারি যান চলাচলের ফলে ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে।
এতো গেলো শুধু ব্রিজের সৌন্দর্যের কথা।ব্রিজের একটু নিচে নামলেই দেখা যায় অন্য এক পৃথিবী,অপরাধীদের যেনো অভয়ারণ্য এই এলাকা, এই ব্রিজ দিয়ে চলাচলকারী লোকজন প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হন। ছিনতাইকারী, হিজড়া, যৌনকর্মী ও তাদের দালালরা অপকর্মের জন্য এই ব্রিজটিকে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। রাতে ওই ব্রিজ দিয়ে চলাচলকারীরা প্রায়ই ছিনতাইর শিকার হন।এছাড়া যৌনকর্মী ও হিজড়াদের আক্রমনের শিকার হতে হয় পথচারীদের। পথচারী ও রিকশারোহীদের গতিরোধ করে তারা জোর করে সাথে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। ইজ্জতের ভয়ে ওই সময় আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকারও দিতে পারেন না।বিভিন্ন সময় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় নি।
ব্রিজ নেমে একটু সামনে গেলে পাওয়া সিএনজি স্টেন্ড। কয়েকবার এই সিএনজি স্টেন্ড সরানোর ব্যবস্থা করা হলেও তা আর হয়ে উঠে নি।ব্রিজের উপর দিয়ে সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও এইসবের কেউ তোয়াক্কা করে না।বেশির ভাগ সময় পায়ে হেটেঁ পার হতে ব্রিজ সাধারণ লোকজনের।রাতে পায়ে হেটেঁ ব্রিজ পার হতে গেলে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় জনসাধারণ এর।
সিলেটের পুরান পুল নামে পরিচিত এই ব্রিজটি সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে বহুযুগ ধরে। সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে হয়তো সিলেটের গর্ব এবং অহংকার আরো এক তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে উঠবে কিন ব্রিজ।