ইবার কাঁচা ধান তো নিলইগা, এখন সব মাছও মরি যাইতেছে আর পানিও নষ্ট অইছে শইল্যে লাগলে খালি চুলকায়
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০১৭, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
‘আগে বন্যা অইলে এক আওর দুই আওর নিত। বাকি আওরের ধান থাকত। কাছামাছা কাইট্যা তুলা যাইত। ফসল গেলেগিও পানি আর মাছের কুনু সমস্যা অইত না। ইবার কাঁচা ধান তো নিলইগা, এখন সব মাছও মরি যাইতেছে। পানিও নষ্ট অইছে। শইল্যে লাগলে খালি চুলকায়। ৬৭ বছরের জীবনে ইলা অবস্থা দেখি নাই, আমার বাপ-দাদাও দেখে নাই। ’
সম্প্রতি বোরো ফসল হারানোর পর এখন হাওরের মাছে মড়ক ও পানিদূষণ নিয়ে শাল্লা উপজেলার ভাণ্ডাবিল হাওরের কৃষক শৈলেন তালুকদার এভাবেই বলছিলেন হাওরের পরিস্থিতির কথা। তাঁর মতো প্রবীণ কৃষকও হাওরজীবনে একসঙ্গে উপর্যুপরি এমন দুর্যোগ দেখেননি। একটি বিপদ চলে গেলে আরেকটি দিয়ে কৃষক কোনোমতে সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারত। এখন মাছ ও পানি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষককুল। ধানের পর এ দুটিই ছিল শেষ ভরসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১২০ বছরে এমন সংকট আসেনি হাওরজীবনে।
সুনামগঞ্জ জেলা মত্স্য অফিস ও হাওরের প্রত্যক্ষদর্শী কৃষকরা জানায়, গত শনিবার থেকে হঠাৎ হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ মরে ভেসে উঠতে থাকে। বিশেষ করে গভীর জলের সুস্বাদু মাছগুলো আধমরা হয়ে নিচ থেকে উঠে হাওরে ভাসতে থাকে। বোয়াল, কাতলা, রিটা, রুই, বাইমসহ সুস্বাদু দেশি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসতে দেখে উত্সুক জনতা তা ধরতে বের হয়। তবে মত্স্য বিভাগ মাইকিং করে এই মাছ না খাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। পানিদূষণ ও মাছের মড়ক ঠেকাতে হাওরে চুন ও জিওলাইট ছিটানো হচ্ছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই কম।
মত্স্য বিভাগ জানিয়েছে, টানা বৃষ্টি হলে এই দুর্যোগ কেটে যাবে। দূর হবে গন্ধ। অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়বে এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণও কমবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কাঁচা ধান পচে নষ্ট হওয়ায় জলাবদ্ধ হাওরে অ্যামোনিয়া গ্যাসের স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। যেখানে অ্যামোনিয়ার মাত্রা ০.২ থাকার সেখানে এই গ্যাসের পরিমাণ এখন ০.৭ মাত্রায় রয়েছে।
শাল্লার ছায়ার হাওরপাড়ের কৃষক কাজলকান্তি চৌধুরী বলেন, ‘ভগবান এই কোন বিপদের মুখে ফেললেন আমাদের। ধান কেড়ে নিলেন, এখন হাওরের মাছও মরে যাচ্ছে। পানিও দূষিত হয়ে গেছে। হাওরবাসীর বেঁচে থাকার অবলম্বন এভাবে একের পর এক নিঃশেষ হয়ে গেলে শেষে শুধু মানুষ থাকবে। কিন্তু মানুষ একাকী কত দিন টিকতে পারবে। ’ এই সংকট থেকে হাওরবাসীকে রক্ষার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
উন্নয়নকর্মী সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, ১৮৯৭ সালের জুনে হাওরাঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। কয়েকটি গ্রাম দেবে গিয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল অনেকগুলো ছোট নদী, খাল ও হাওর-বিলের। অনেক হতাহতসহ মানুষ স্থায়ীভাবে বাস্তুভিটা হারিয়েছিল। এবার ভিন্ন রকম সংকটের মুখে কৃষক। ধানের পর মাছ, মাছের পর পানি আক্রান্ত হয়েছে।
এদিকে হাওরের মাছ মরে যাওয়ার পর গত সোমবার ধর্মপাশার বিভিন্ন হাওরে পানি ও মাছ পরীক্ষা করেছে মত্স্য গবেষণা কেন্দ্র। গবেষকরা মাছের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পানিতে মাত্রাতিরিক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি ও অক্সিজেন অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
জেলা মত্স্য অফিসার শঙ্কর রঞ্জন দাস বলেন, ‘মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদল পানি ও মাছ পরীক্ষা করে গেছে। তারা জানিয়েছে, ধান পচে যাওয়ার কারণে পানিতে অক্সিজেন একেবারে কমে গেছে। অন্যদিকে অ্যামোনিয়া গ্যাস বেড়ে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ। এ কারণে হাওরের মাছ মরে ভেসে উঠছে। মাছের মড়ক ঠেকাতে আমরা চুন ও জিওলাইট ব্যবহার করছি। এতে মাছও রক্ষা পাবে, পানিদূষণও রোধ হবে। ’ তিনি জানান, টানা বৃষ্টি হলে এ সমস্যা কেটে যাবে। তা ছাড়া এ অবস্থা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।