সিলেটি লন্ডনীদের পূর্বপুরুষ মতছির আলী : সিলেটিরা আপনার জন্য গর্বিত
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৪৪:০৬,অপরাহ্ন ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান:
হাঁ অবশ্যই নির্দ্বিধায় বলতেই হয়, আমরা সিলেটিদের শান শৌকত শিক্ষা ঐতিহ্যের ম্রিয়মাণ অবস্থা হতে পুনর্জীবন ঘটাতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে আমাদের জাহাজী ( নাবিক) পূর্বপুরুষদের কাছে। আমরা অসাবধানতা বশতঃ বলে থাকি বা অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাই বা বলে থাকি যে, লন্ডনের মোহে আমাদের সিলেটের শিক্ষার হার কমে যায় বা দেশে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিদেশ পাড়ি জমানোতে শিক্ষার প্রতি আমাদের দৈনা দশা ঘটে। অথবা কোন কোন জ্ঞানপাপী সিলেট বিদ্বেষী্রা বলে থাকেন, সিলেটিরা শিক্ষিতই নয় আদৌ বা লন্ডনের দিকে একটা ন্যাকারজনক ভাবসাব প্রকাশ করেন। এমনকি কিছু কিছু অধুনা শিক্ষিত সিলেটীরা ঐসব কুশিক্ষিতদের দলে। ধিক জানাই তোমাদের। দেখে নাও জেনে নাও এই আমাদের সিলেট শহরতলীর মোল্লার গাঁও গ্রামের আমাদের পূর্ব পুরুষ লন্ডনী জাহাজি সিলেটীকে।
জনাব মতছির আলী যিনি ছিলেন উনার প্রথম জীবনে সিলেট বড়ইকান্দি প্রাইমারী স্কুলের শিক্কক। ১৯৩৬ সালে ভাগ্যান্বেষণে ছুটলেন রাজধানী শহর কলিকাতায়। তখনকার দিনে এটাই ছিল অত্র অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনাচার। যেমন বাসা বাড়ি তৈরি করতে হলে কলিকাতা বা শিলং কর। বায়োস্কুপ দেখবে বা বেড়াবে চলে যাও কলিকাতা। তাছাড়া আরও একটা এডভেঞ্চার জাহাজে চাকুরী নেও সুদর প্রসারী চিন্তা হল একেবারে বৃটিশ রাজের রাজধানী লন্ডনে পাড়ি দেওয়া। কলিকাতা বা জাহাজের চাকুরী সিলেটিদের জন্য তেমন আরাধ্য ছিল না, মুল আরাধ্য ছিল প্রেস্টিজিয়াস ‘’ ইংলিশ আর্টিকেল’’ এর অধীনে সি- মেন হওয়া। সেই সুবাধে লন্ডন বসতি স্তাপন করা। তখনকার সময়ে যারা ‘’ইংলিশ আর্টিকেলে’’ কাজ করতে হত, তাদের অবশ্যই মিনিয়াম সেই সময়কার স্টেন্ডারে শিক্ষিত হতে হত। নিজের ফর্ম নিজে পূরণ করা ও ভাষাগত জ্ঞান ছিল আবশ্যক।
আমাদের এই গর্বিত মতছির আলী, মাস্টার সাহেব কলিকাতা যেয়ে সরাসরি ইউরোপ আমেরিক গামী জাহাজের চাকুরীর সংস্থান করতে পারলেন না। শিক্ষিত মানুষ তাই চলে গেলেন, জমশেদ পুরের টাটা কোম্পানিতে। কিন্ত জমশেদ পুরের মাসিক ৩০ টাকা বেতন এর চাকুরী মনে শান্তি দিতে পারছে না। অভীষ্ট লক্ষ যে অন্য কোথায়, উনাকে ডাকছে নীল সাগর ও আমেরিকা বিলেতের জীবন। চাকুরী ছেড়ে দিয়ে জাহাজের একটা চাকুরী নিয়ে চললেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাথায় নিয়ে জাহাজ নিয়ে চলছেন এদিক সেদিক।উনার জাহাজ ‘ এস এস সেন্ট আস্ক’ ১৯৪১ সালে মধ্য আটালান্টিকে পড়ল শত্রুর নিশানায়। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেনে ব্রাজিলের হাস্পাতালে।ছয় মাস পরে মোটামুটি সুস্থ হলেও শক্তি হারান ডান হাতের। একটা আঙ্গুল চিরতরে অকেজ হয়ে পড়ে।এর দুই মাস পড়ে চলে আসেন নিজের বসতি বিলেতে। উনার মামা সৈয়দ তফুজ্জুল আলীর গ্লাসগোর বোর্ডিং এ চাকুরী করতে শুরু করেন।
দিন কাল ভালোই যাচ্ছিল কিন্ত আসল বাড়ি যাবার পালা। ১৯৪৬ সাল বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিছেন। কি নিবেন এই সংগ্রামময় জীবনরে শেষে। কি নিতে পারেন একজন জাহাজি সিলেটি সাথে করে।উনি যা নিয়েছিলেন সাথে করে ও উনার যে দৃস্টিভঙ্গীর উন্মোচন হয়েছিল আমার কাছে, তার প্রেরণায় এই লেখার তাগাদা পাই।
আর কিছু নয়, জ্ঞান আর জ্ঞান ট্রাঙ্ক ভরে নিয়ে গেলেন তিনশত বই। গ্রামে যেয়ে এলাকার সব ছেলেকে ডেকে এনে ট্রাঙ্ক দেখিয়ে বললেন, এই গুলি নিয়ে এসেছি তোমাদের জন্য, আমার এলাকার জন্য।এখন তোমার চাঁদা তুলে নিজেরা বাংলা বই কিন।আমিও তুমাদের সাথে চাঁদা দিব। ইংলিশ বই আমি পড়ে পড়ে তুমাদের বুঝিয়ে দিব। এই হল আমাদের লন্ডনী জাহাজি পূর্ব পুরুষদের প্রাজ্ঞতা। এলাকার ছেলেরা চাঁদা সংগ্রহ করে চারশত বাংলা বই কিনে ফেলল এবং আরও একশত বই উৎসাহী ছাত্র যুবকরা দান করল। গড়ে উঠল এক বিশাল লাইব্রেরি। নাম দেওয়া হল ‘খিত্তা স্টুডেন্টস লাইব্রেরী’’।
শুধু তাই না, জনাব মতছির আলী সবাইকে বলে দিলেন গ্রেজুয়েশন বা অন্তত ইন্টারমেডিয়েট না করে কেউ বিলেত যাবার নাম ধরতে পারবে না। তখনকার দিনে পাসপোর্ট পাওয়া ছিল খুবই মুস্কিল। উনি বললেন এই ব্যাপারে উনি পৃস্টপোষকতা করতে পিছপা হবেন না।
তাই জানতে ইচ্ছে করে সিলেট শহর তলীর খিত্তা / বরইকান্দির মানুষ উনাকে কিভাবে স্মরণে রেখেছে? নাকি লেখা পড়ায় গুরুত্ব না দিয়ে শুধু বিলেত, আমেরিকা ও পয়সার পিছনে দৌড়িয়েছেন। আমার মনে হয় যদি সেটাই হয়ে থাকে তবে বড় দুঃখজনক হবে ব্যাপারটা। উনার বই গুলি বা পাঠাগারের কোন নাম নিশান আছে কিনা ? না হবাক হওয়ার মত লাখ দশেক বই আছে সেথায়। যা বাংলাদেশের মধ্যে সর্ব বৃহৎ গ্রাম্য প্রাচীন পাঠাগার হিসাবে উজ্জলাতার স্বাক্ষর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার সহপাঠী, সৈয়দ শাহরিয়ার/ শাব্বির নাজমি (পুলক)/ সেলিম খান/ কবির আহমেদ/ সাব্বির ভাই/ মন্তাজির ( কানাডা) তারা সবাই ঐ এলাকার, উনারা যদি দয়া করে বা ঐ এলাকার অন্য কোন কেউ জানাতেন তাহলে কৃতার্থ হতাম।
পরিশেষে এই আবেদন করতে চাই, চলেন আমাদের দৃস্টিটা সুন্দর ও সততার দিকে ফিরিয়ে এনে ম্রিয়মান ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করে আমাদের পূর্ব পুরুষদের যে আশা আকাঙ্ক্ষা আমাদের উপড়ে ছিল তার বাস্তবায়নের প্রচেস্টায় প্রবিত্ত হই। ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখকঃ মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান (এডভোকেট)