কাঁঠালচাঁপার আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া প্রহর (২১ তম খণ্ড)
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৬:৫০ অপরাহ্ণ
জাকির মোহাম্মদ:
মাইজভাগ রেলস্টেশনের ফ্লাটফর্মে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ হলো। চারদিকে হকারের হাঁকডাক থাকলেও লোকজনের দেখা বেশ নেই। যেন সুনশান নিরবতাই থাকে প্রায়ই। এটি আমার দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলা। আসলে স্টেশন কখনো এত নির্জন আর কোলাহলের ভীড়ে না থেকে পারেই না। কিছুক্ষণ আগে ফেরদৌসির সাথে কথা হয়েছে। লিজার বের হতে দেরি হবার জন্য আমাদের কিছুক্ষণ যে বসতেই হবে সেটি আর দ্বিতীয়বার বলছি না। মাইজভাগ রেল স্টেশনের গোড়াপত্তন নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। এরপরও শুভ চারদিকে চাইবার ফিরিস্তি মনে করিয়ে দিচ্ছে সে কিছু খোঁজবে? সামনেই ছোট একটি পত্রিকার স্টল সেখানে কি যেন খোঁজতে মরিয়া। মনে মনে হেসে উঠি। এক সময় কি এক ম্যাজিকে পড়ে থাকতাম এসব দোকানের ভেতর। আহা! রসময়, কত রস গিলে খেলেন সময়ের অজান্তেই। শুভর হাতে একটি উপন্যাস। উপন্যাসখানের নাম দেখে ভেতরটা ছলকে উটলো যেন। লেখক তিথীপ্রিয়া,যার জন্ম বিমানে হয়েছিল বলে অনেক অহংবোধ ছিল,সেটি বইয়ের শেষের ফ্ল্যাশে অবশ্যই লেখা থাকতো। রসময়ের মত ইনার লেখাতেও রক্তটগবগ করে উটতো। পড়ে পড়ে কোথায় হারাতো শরীর সে জানা আমাদের কর্ম ছিল না। এখানে পড়ে শেষ করা গেলেও কে আগে পড়বে এ নিয়ে ঝামেলা লাগার সমূহ বিপদ দেখে শুভ বললো থাক,বাসায় রাতে পড়া যাবে। আমরা বরং এই বাঁকা নারকেল গাছটার নীচ থেকে আসি। রেল স্টেশনের পাশে যে ছোট্ট রাস্তা গেছে তা পাড়ি দিলেই ছোট্ট একটি পুকুর। পুকুরেন এক কোণ জুড়ে বাঁকানো নারকেল গাছটি প্রকৃতিকে অপরূপ রূপবতী করে রেখেছে। ঝির ঝির নারকেল বাতাসে গোঁমট গরমে যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ ছবি তুলার পর নতুন মনে করে আমাদের সাথে স্থানীয় দুটি তরুন আসলেন কথা বলতে। হাসিমুখে আমাদের কথা শুরু হলেও তারা ততটাই গাম্ভীর্য রেখেছেন। কেন এখানে ছবিটবি তুলছি তার একটা হিসেব নেবার তাড়না তাদের। দীর্ঘ আলোচনা হলো,চেনা জানা হলো। এক সময় দেখা গেল তারা দুজনই আমাদের দুটি ফ্রেন্ডের ছোট ভাই। এবার আতিথেয়তা দেবার পালা। না না না, আপনারা আমাদের এলাকাতে বেড়াতে এসেছেন কিছু মুখে না দিয়ে যেতে দেবো না। আসুন,চা পর্বটা সেরে নেই,পরে অন্যকিছু। একেবারে নাছোড় তাড়া। গেলাম চায়ের দোকানে। সেখানেও কথা বলতে বলতে পরিচিতমুখ আরেকজন পেয়ে গেলাম। যে নির্জনতার ভেতর আড্ডা দিতে গেলাম,সেখানে এত এত পরিচিত মুখের সন্ধান আমাদের আড্ডাটাকে না আবা বিফল করে দেয় কে জানে?
মুখে বিরাট হাসি নিয়ে ফেরদৌসি আর লিজা সামনে আসলো। প্রয়োজনের চাইতে বেশি কথা বলছে আজ লিজা। সে পাশ কাটাতে চাইছে দেরি হবার বিষয়। কাজল ভাই, আমার জন্যই দেরি হয়ে গেছে প্লিজ রাগ করবেন না। ঠিক আছে তো। আর দেখেন দেরি কি এমনি এমনি হয়েছে। ডিম,নুডুল,স্যান্ডুইচ সব আপনার জন্য।
হ্যাঁ, আমরা তো না খেয়ে এসেছি গত একমাস। সে খাবার রেডি করার জন্য দেরি হতেই পারে। ফেরদৌসির স্বজোরে হাসি আর শুভ পেঠের ক্ষুধাবোধ আমাকেও রীতিমতো হাসির আয়োজনে যোগ দিতে হলো। নাস্তা পর্ব যেই শেষ হলো মাইজভাগ স্টেশনকে আমার মনে হলো যেন শাপলাবিল। লাল লাল শাপলাফুলে ছেয়ে আছে সমস্ত স্টেশন। আর স্টেশনের মধ্যখানে কেবল আমি আর ফেরদৌসি বসে আছি শাপলাফুলের মতো জড়াজড়ি করে। আমরা গরমগোঁমটবাতাসে নেয়ে নেয়ে কোথায় একাকার হবো তা না,আমরা হঠাৎ করে ঠান্ডা হতে শুরু করলাম যেন এই মাত্র বরফের বাগান থেকে বরফকুয়াশা দিয়ে আমাদের ঢেকে ফেলা হচ্ছে। যত বরফকুয়াশাবোধ হচ্ছে ঠিক তত যেন আমরা দুজনে শিমলতার মত পেছিয়ে একে অন্যে বাঁচার আকুতি প্রকাশ করছি। ফেরদৌসির লাল ড্রেসকে আর ড্রেস মনে হচ্ছে না। শাপলার মত
লাগছে। স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছি। যেভাবে শাপলাফুল কাছে পেলেই আমি স্পর্শের জন্য ব্যাকুল হই প্রতিবার। দক্ষিণের ঝিরি বাতাসে শাপলাফুলের পাতা ভাসছে,থর থর করে কাঁপছে। আমি সেই কাঁপানোতে বিভোর হচ্ছি। আমি আর ফেরদৌসি তখনও বিভোর মায়ায় ছুটাছুটি করছি স্টেশনের লাল শাপলার বিলে। আমাদের চারদিকে বিলের মাছেরা যেন ঢাক আর ঢুলের আওয়াজ তুলেছে। সেই আওয়াজে আমরা শাপলাবিলের জলে ক্রমশ নাব্যতা চেখে দেখার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছি।
এ সময় ট্রেন এসে মাইজভাগ স্টেশনে থামলো। জয়ন্তিকা সাধারনত এ সময় আসে না। আমাদের লিফট দেবার জন্যই বুঝি জয়ন্তিকার এই হঠাৎ আগমন। আমরা হুড়মুড় করে জয়ন্তিকায় উঠে পড়লাম। কোথায় যাবো জানিনা। কেবল মনে হচ্ছে এটি ট্রেন নয়। ময়ূরকণ্ঠী নৌকা বুঝি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলছে কোন অজানার পথে। মুখোমুখি সে আর আমি। তার সজল দৃষ্টি বাইরের সবুজের সাথে কী অপরূপ সখ্যতা গড়ে তুলেছে এই ধ্যানমগ্নতা ভাঙ্গার শক্তি আমার নেই। আঙুলের ফাঁকে গুঁজে রেখেছি দুটি আঙুল। সে এক হাত দিয় উশৃঙ্খল চুলকে বারবার আঁটাবার ব্যাবস্থা করছে। ময়ূরকণ্ঠী নৌকায় ভাসানো চুলে সে বাধ্যতা মানতে নারাজ সেটি বারবার দেখছি। হঠাৎ ফেরদৌসির চুলকে আমার কাশফুলের বাগান মনে হয়। হেলছে, দোলছে। আর আমি তার চুলের ভেতর আমার আঙুল চালান করে দিচ্ছি পরম সুখে,মমতায়। সে সুখ আর মমতা বুঝি ফেরদৌসিকে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ এমন কোন রহস্যের কিনারে যেখানে অামার অবস্থান নড়বড়ে। অথচ সেখানে আমার অবস্থানটাই পাকাপোক্ত হবার সম্ভাবনা ছিল,কিন্তু অনেক কিছুই সম্ভব না। নারকেল, চানাচুর,বাদাম আর ভিক্ষুকদের সুরেলা আওয়াজ হোক আর শুভর ইঙ্গিতবাহি কথা যেকোন একটির কারণেই অথবা দুটির কারণেই আমার চিন্তার দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। আর ফেরদৌসি দেখলাম আমার দিকে অপার নয়নে চেয়ে আছে। সে দৃষ্টি যেন অথৈ সাগর। যার কোন কিনারা নেই।
শুভ আর লিজা ইতোমধ্যে খুব ঘনিষ্ট হয়ে গেছে আলোচনার ফাঁকে সেটি বুঝতে পারছি। তারা পাশেই আরেকটি সিটে বসে গল্প করছে। সেখান থেকে মাঝে মাঝে হাঁকছেড়ে ডাকছে। সেই ডাকে ফেরদৌসি কিছু বলেছে আর তখনই আমার ধ্যানাসন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আমি দেখতে পাই ট্রেন চলচে ঝিক ঝিক ঝিক। আর আমার ময়ূরকণ্ঠী নৌকা কোথায় যে ভেসে গেছে তার হিসেব নিতে পারছি না। তখনও আমার আঙুলে কবিতা লেখছে ফেরদৌসি, তখনও আমার আঙুলে গল্প পড়ছে ফেরদৌসি। সে কবিতার কথা,সে গল্পের কথা বয়ান করে করে যেন আমার পথ চলা আরও সামনে এগুচ্ছে, আর কতদূর এগুচ্ছে সেটির হিসেব কষতেই আজকের যাত্রাপথ…চলবে