কাঁঠালপাতার আর্তনাদে হারিয়ে যাওয়া প্রহর : ১৯তম খণ্ড
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১৯:৪৫,অপরাহ্ন ১৬ জুলাই ২০২০
জাকির মোহাম্মদ:
করচতলায় বেশিক্ষণ আর বসতে হল না। বকুল এসে একেবারে হইচই শুরু করে দিল। তার সাথে আছে আরও কিছু ফাজিল, সবকিছু মিলিয়ে ফেরদৌসির মুখের দিকে তাকানোটা খুব কষ্টের ছিল। বকুল সেটি বুঝে গেল কি না জানিনা,তবুও বলল…
কি ব্যাপার, পেঠে ক্ষিধে রেখে এখানে বসলে তো জমে না,তাই না?
ফেরদৌসি বলল,তাতো ঠিক,চলো রিফাতে।
অনেকক্ষণ ধরে আমিও চাচ্ছি।
কাজল উটছে না,তাই বসে আছি।
চলো, যাওয়া যাক।
একদল সৈন্যসামন্ত ঘেরাও করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন,ইতিহাসের সামনে এসেই পেয়ে গেলাম বন্ধুদের আরেক দল। তাদের সাথে কথা বলে,রিফাতে চললাম।
রিফাতে আর আখনি পাওয়া গেল না। গেলেও এত মানুষের হত না,সুতরাং না পাওয়াটা ভালো হয়েছে। বকুলের রঙ চা আর সবার দুধ চা’র সাথে ডেনিসের আমন্ত্রণ জানালাম। অনেকদিন ডেনিস খাইনা বলে পুড়ন কাটলো ফেরদৌসি। বকুল মহাসাড়ম্বে ডেনিসে কামড় বসালো। রিফাত চা নিয়ে আসার আগেই সবার ডেনিস শেষ হয়ে গেল। সে আবার অন্য কিছু আনার হইচই শুরু করে দিল।
আমাদের ঠিক সামনে ক্যাম্পাসের কিছু জারুল গাছে জারুলের বেগুনি ফুল ফুটেছে। এত সুন্দর ফুল। দেখতে বারবার ইচ্ছে করে। জারুলের ফুলে মাটি একাকার। পথিকের পা যেন হঠাৎ রঙিন করে তুলে মাঝে মাঝে।
ফেরদৌসি একদিন পা থেকে জুতো খুলে তার পা জারুলের ফুল পানিতে পড়ে যে বেগুনি রঙ ধরেছে সেখানে ডুবিয়ে রাখে। আলতার মত বেগুনি রঙ ফুটে ওঠে ফেরদৌসির পায়ে। এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য সেদিন উপলব্দি করেছিলাম। রিফাতে বসে সেটি বারবার মনে হচ্ছে।
চলো,পা ডুবাই জারুলের ফুলে?
সত্যি?
হ্যাঁ, চলো।
বকুলের সাথে থাকা লোকজন চলে যায়,আমরা আবার ক্যাম্পাসে ঢুকি।
ক্যাম্পাসে আমাদের আসার সময় ছিল, যাবার সময় কখন কেউ কোনদিন জানতাম না।
প্রিন্সিপাল স্যারের বাসার রাস্তা দিয়ে শহিদ মিনারের কাছাকাছি যাবার পথে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। বকুল সাথে থাকলে ছবির অভাব হয় না। সে ক্লিক করতেই থাকে। সোনালু ফুল পেড়ে দিতে হবে। ফেরদৌসির বায়না। একটু উঁচুতে। বললাম,না পাড়াপাড়ি নাই। চলো,ছবি ওঠাই। বকুল আছে সে ছবি তুলে দিক। আমরা সোনালুকে মাথার উপরে রেখে দাঁড়িয়ে গেলাম আবার।
পেছনদিক থেকে উলুপোড়া আমাকে ঝাপটে ধরলো।
কাজল ভাই কেমন আছেন?
ভালো,তোর খবর কি?
আছি ভাই।
আমারও চলছে। বকুল,ফেরদৌসিকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি।
আমাকে ডাকতে পারতেন?
মনে করেছিলাম,ক্যাম্পাসে এলে পাবো,তাই ডাকিনি। পেয়ে গেলামতো।
সেটি আমি,দেখেছি বলে?
না দেখলে তো আজ দেখা হতো না।
উলুপোড়া, ফেরদৌসির সাথে কুশল বিনীময় করে। আমরা ল্যাংটেনা ফুলের ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। বকুল অন্যপ্রজাতির গাছের পাতার ছবি তুলে। ফেরদৌসির সাথে কোন গাছের পাতার কোন রঙ ধরে সেটি জানায়। সেদিন ক্যাম্পাসের অনেক গাছের গণনা শুরু করি আমরা। কত প্রজাতির গাছ আছে সেটিও জানার বিষয়।
ফেরদৌসি হঠাৎ রবীবাবুরে স্মরণ করে। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ে চিহ্ন এই বাটে’। সত্যি সত্যি তো একদিন কি আমাদের পায়ের চিহ্ন পড়বে এখানে। এই সবুজ গাছ,সোনালু ফুল,লাল গাছের পাতা,হৈমন্তীর সৌন্দর্য, জারুলের রঙ,করচের গন্ধ,পুকুরে জলের ঢেউ,ঘাসের লড়াচড়া,শহিদ মিনার,মিনারের সিঁড়িতে আড্ডা,আড্ডার গানগুলি,ঝাউগাছ,ঝিরিঝিরি বাতাস,পদার্থ বিদ্যার ব্রিজ,নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার কুলকুল ধ্বনি, রসায়নের বিক্রিয়া,উদ্ভিদ বিজ্ঞানের রস,রূপ,জেনেটিক্স তথ্য সত্যিইতো এসবে আর আমাদের চিহ্ন থাকবে না।
গানের সুরে বিমুগ্ধ আমির সাথে কথা বলছি,ফেরদৌসি ধাক্কা দেয়? কি হলো?
না,গানে বিভোর এই মুহুর্তে।
সে আবার গান ধরলো,’ও আমার দেশের মাটি,তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধতার কাল। শহিদ মিনারের সকল বাদামের খোসা যেন গানের সুরের সাথে নেচে উটলো। বকুলের সাথে অট্টহাসিতে মেতে ওঠলাম। রবীবাবুর এ গানের সাথে বন্ধুদের দুষ্টুমির কিছু অংশ মনে পড়েছে আমাদের।
ফেরদৌসি হতভম্ব।
গানের সুর ছেড়ে দিছে।
হাতের পার্টস দিয়ে পিঠে বাড়ি মারে।
বকুল আবার হাসে।
উলুপোড়াও হাসতে শুরু করে।
আর ফেরদৌসিও গানে আবার টান দেয়।
‘ও আমার দেশের মাটি,তোমার পরে ঠেকাই মাথা’
আমাদের গানের রেশ কাটতে না কাটতেই বকুলের সাথে থাকা লোকজন আবার আমাদের কাছে আসলে।
আর সকলের ইচ্ছায় উলুপোড়া ধামাইল গানে টান দিল। শহিদ মিনার থেকে লাফিয়ে সবাই সমতলে গেল।
গোল হয়ে, ‘জলে গিয়াছিলাম সই,কালা কাজলের মাটি, দেখিয়া আইলাম কই,জলে গিয়াছিলাম সই’ রাধারমণের গানের সাথে সবাই নাচতে শুরু করলো। নিস্তব্ধ বিকেলে, আনন্দের তর্জমা নিতে বেড়াতে আসা সকল দর্শনার্থী আমাদের ঘিরে ফেললেন।
চলছে, ধামাইল। আড়চোখে ফেরদৌসিকে দেখলাম। বেশ মজাপাচ্ছে। কানে কানে বলল,কি অদ্ভুত মানুষ তোমরা। সেও,ধামাইলে শরিক হলো,বেজোড় তালিটা তার সেটি লক্ষ্য করেই বকুল আর স্বরূপ বলল,হয়ে যাবে একদিন।
চলবে…