হুঁশিয়ারি আর অভিযানেও থামছে না চালবাজি
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
চালের দাম ৪ দিনের মধ্যে আগের দামে ফিরিয়ে আনতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের হুঁশিয়ারির পরও পণ্যটির দাম কমেনি। অথচ এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের গুদামেও চালের মজুত পর্যাপ্ত। সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরেও ভরা মৌসুমে অস্থির চালের বাজার। ওদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু বাজারে অভিযান চালিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ ভোক্তা সাধারণের।
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের পর মিল পর্যায় থেকে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ টাকা দাম বাড়িয়ে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশের পাইকারি বাজারে হু হু করে বেড়েছে দাম। প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। গরিবের মোটা চাল ক্রয়েও কেজিপ্রতি ৫৬ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সরু চাল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকায়। ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে খোদ খাদ্যমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিলেও বাজারে এক প্রকার দায়সারা তদারকি করছে কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযানে পাইকারি পর্যায়ে সামান্য দাম কমেছে। বিক্রেতারা বলছেন, বস্তায় ৩০০ টাকা বাড়লেও কমেছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
গত বুধবার খাদ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ধান-চালের বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে এক মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী এই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, চার দিনের মধ্যে আগের দামে না আনলে মজুতকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে চাল আমদানি করা হবে। কিন্তু চার দিন পরও খুচরা বাজারে এখনো বাড়তি দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে। তিনি জানান, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তাই কঠোরভাবে তদারকির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সে মোতাবেক নির্দেশও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি করপোরেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠক করা হবে।
এদিকে সংসদ নির্বাচনের পর হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরে শাহ আলী বাজার এবং উত্তর বাড্ডায় চালের বাজারে অভিযান পরিচালনা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি দল। রাজধানীর বাজার ঘুরে ট্রেড লাইসেন্স না থাকা, বেশি দামে চাল বিক্রি ও মূল্যতালিকা না থাকাসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি মাত্র ৩০ মিনিটেই বাজার তদারকি শেষ করে চলে যান তারা। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে তদারকিতে আসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব কুল প্রদীপ চাকমার নেতৃত্বে একটি টিম। সেখানে ১১টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করেন তারা। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার নওগাঁয় অবৈধভাবে ধান-চাল মজুত রাখার অপরাধে ৬ জন ব্যবসায়ীকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মহাদেবপুর উপজেলার তিনটি চালকলের মালিক এবং বদলগাছী ও মান্দা উপজেলার তিন চাল ব্যবসায়ীকে এ জরিমানা করা হয়। এ নিয়ে ৩ দিনে নওগাঁয় ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বৃহস্পতিবার বলেছেন, সরকার বড় কোম্পানিগুলোতে সুবিধা দিয়েছিল কম দামে চাল প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। তারা যদি ‘সত্যিকারের ব্যবসায়িক আচরণ’ না করে তাহলে চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। অভিযান শেষে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সেলিমুল আজম বলেন, বাবুবাজারে অভিযানে দেখেছি সেখানে কেজিপ্রতি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৭০ টাকা। একই দিন কাওরান বাজারে আমরা ৬৬-৬৭ টাকা দেখেছি। খুচরা ও পাইকারি দোকানদারদের সতর্ক করছি। পরে আইনপ্রয়োগ, জরিমানা বা শাস্তির দিকে যাবো।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে (১৭ই জানুয়ারি), দেশে মোট ১৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬২৪ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৮ টন, গম ২ লাখ ২২ হাজার ৪৪ টন ও ধান ১৬ হাজার ৯০০ টন। মন্ত্রণালয় বলছে দেশে খাদ্যশস্যের মজুত পর্যাপ্ত রয়েছে।
নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর মিল পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বস্তা মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগে ২১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বস্তা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা, যা আগে ২২০০ টাকা ছিল। আর প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা, যা আগে ২৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের তিনটি পাইকারি দোকানের মূল্যতালিকায় দেখা যায়, একই চালের দাম তিন দোকানে তিন রকম। যেমন আটাশ চাল প্রতি কেজি এক দোকানে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়, আরেক দোকানে ৫৩ টাকায় এবং অন্য দোকানে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকায়। অন্য চালের দামেও ভিন্নতা দেখা যায়। দুই দোকানে মূল্যতালিকায় মিনিকেট চালের কেজি ৬৬ টাকা এবং আরেকটি দোকানে ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন দামের প্রসঙ্গে পাইকাররা বলছেন, তাদের কারও কারও পুরনো চাল রয়ে গেছে, তাই তারা আগের দামেই বিক্রি করছেন।
কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। রাজধানীর খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণাজাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি দাম বেড়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা, যা আগে ৬৫-৭০ টাকা ছিল। আর কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি নাজিরশাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকা।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ধান কাটার মৌসুম এলেই মিলাররা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ান। এবারও সেটাই হয়েছে। আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে, তারপরও দাম কমছে না। তাই মূল্য কারসাজিতে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বাজারে চাল কিনতে ক্রেতার ভোগান্তি বাড়বে।