কারাবন্দির স্বজনদের আহাজারি, নূরীর কান্নার জবাব নেই
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ৬:৩২ অপরাহ্ণ
কেউ এসেছেন কোলের শিশু নিয়ে, কেউ এসেছেন অবুঝ সন্তান নিয়ে, আবার কেউ নাতি-নাতনি নিয়ে। বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী, ভাই-বোনরাও এসেছেন। তাদের কারও চোখে পানি, কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে ব্যানার। তারা সবাই বিরোধী রাজনৈতিক দলের ‘নির্যাতিত’ নেতাকর্মীদের স্বজন। বিএনপি’র এসব নেতাদের মধ্যে কেউ শিকার হয়েছেন গুম-খুনের, কেউ বা আছেন কারাগারে। গতকাল প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে স্বজনদের মুক্তি দাবি করেছেন তারা।
রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে দাদা-দাদির হাত ধরে আসে দুই অবুঝ শিশু বর্ষা ও নূরী। মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে কারাবন্দি মায়ের জন্য মুক্তি দাবি করে এই দুই শিশুকন্যা। শিশু বর্ষা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে, আমার মাকে ছেড়ে দেন। আমার পরীক্ষা। আমি মাকে ছাড়া স্কুলে যেতে পারি না।
এ সময় পাশে থাকা বৃদ্ধ দাদি বলেন, আমার ছেলে আবদুল হামিদকে না পেয়ে পুত্রবধূ পুতুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তার নামে তো কোনো মামলা নেই।
আমার পুরো পরিবার বিএনপি করে- এটাই অপরাধ। চারদিন ধরে আমার বউমার সঙ্গে দেখাও করতে পারছি না। দুটি দুধের শিশুকে আমি সামলাতে পারি না। সারারাত ঘুমাতে পারি না।
বোন ও দাদি যখন কথা বলছিলেন তখন অঝোর ধারায় কাঁদছিল ছোট্ট শিশু নূরী। তার কান্নার জবাব দেয়ার ভাষা ছিল না কারও।
তিন ছেলের গ্রেপ্তারের বর্ণনা দিয়ে পিতা আব্দুল হাই বলেন, আমার তিন সন্তানকে কারান্তরীণ করা হয়েছে। এক ছেলেকে ১০ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। বড় ছেলেকে না পেয়ে তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে পুত্রবধূকে তিনদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে পুলিশ। অথচ, আমার ছেলের বউ রাজনীতিতে জড়িত নন। তিনি বলেন, বিএনপি করা কি আমাদের অপরাধ? আমরা শুধু সুষ্ঠু ভোটের অধিকার চেয়েছি।
দুধের শিশু কোলে নিয়ে আসা নাজমা খাতুন বলেন, আমার স্বামী তানভীর আহমেদ কোনো রাজনীতি করেন না। গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ১৭ই অক্টোবর রাতে সাড়ে ৯টায় গার্মেন্টস ছুটি হওয়ার পর বাসায় এসে ভাত খান। অসুস্থ শিশুকন্যার জন্য ওষুধ আনতে বাইরে যায়। ওই সময় বাসার গেটের সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আমার স্বামী জানেন না কোন কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম- নাশকতার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বামীর ইনকামে আমার সংসার চলে। আমার ছোট ছোট দুটি বাচ্চা। শ্বশুর-শাশুড়ি অসুস্থ। এক মাস ১২ দিন ধরে কারাগারে। এখন বাসাভাড়া দেবো কীভাবে, কীভাবে সংসার চালাবো বুঝে উঠতে পারছি না। জামিনের আবেদন করেছি- কিন্তু জামিন দিচ্ছে না।
কারাবন্দি স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবুল কালামের ছয় বছরের ছেলে সিয়ামও মায়ের সঙ্গে এসেছে এই স্বজনদের প্রতিবাদ সমাবেশে। শিশু সিয়াম কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার বাবাকে ছেড়ে দেন, প্লিজ আমার বাবাকে ছেড়ে দেন।
মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গুম-খুন ও কারা নির্যাতিত নেতাদের স্বজনদের নিয়ে বিএনপি এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন কারাবন্দি বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের সহধর্মিণী আফরোজা আব্বাস।
মানববন্ধন শেষে নির্যাতিত পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়ার চেষ্টা করলে প্রেস ক্লাবে সামনেই বাধা দেয় পুলিশ। পরে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানের নেতৃত্ব নির্যাতিত পরিবারের চারজনকে যাওয়ার অনুমতি দেয় পুলিশ। স্মারকলিপি নিয়ে পরিবারের পক্ষে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গেলে রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে তা গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তীতে স্মারকলিপিটি ডাকযোগে পাঠানো হয়।
২০১৩ সালের গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা কাওসারের স্ত্রী মিনু আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার সন্তানের বয়স ১৩ বছর, সে বুঝ হওয়ার পর বাবাকে দেখে নাই। যখন সে বলে মা আমার বাবার মুখ কি আর দেখতে পারবো না? তখন বুকটা ফেটে যায়। ১০ বছর ধরে সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।
ঢাকা মহানগর বিএনপি’র নেতা লিয়ন হক ও রাজীব হাসানের বড়বোন আফরোজা পারভীন জেবা বলেন, আমার দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এক ভাইকে পুলিশ এক মাস গুম করে রাখার পর গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। আমার পরিবার সদস্যদের গ্রেপ্তার-গুম-খুন করে সরকার তছনছ করে দিয়েছে। এক বছর আগে আমার ভগ্নিপতিকে লক্ষ্মীপুরে র্যাব গুলি করে মেরে ফেলেছে। তারা প্রথমে লাশ পর্যন্ত দিতে চায়নি। সরকার প্রধানকে বলবো, যদি আমার এবং আমার পরিবারের বাঁচার অধিকার না থাকে তাহলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন, একজন একজন করে কষ্ট দিয়ে মারবেন না। আমরা বিএনপি’র রাজনীতি করে অপরাধ করেছি- আমরা পুরো পরিবার এখন মরতে চাই।
ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ মনিরুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা জামান বলেন, রাত দুইটার দিকে দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আমার বৃদ্ধ স্বামী পুলিশকে কতো আকুতি-মিনতি করলো, বয়স্ক-অসুস্থ নির্দোষ। কিন্তু পুলিশ বাসায় ভাঙচুর করে নির্দয়ভাবে তাকে তুলে নিয়ে যায়।
কারাবন্দি ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমানের ভাতিজি মার্জিয়া বলেন, আমার চাচাকে না পেয়ে পুলিশ আমার বাবাকে নিয়ে নির্যাতন করেছে। রিমান্ডে নিয়েছে। তারপর আমার চাচাকে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন করেছে, অনেকদিন রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের কী অপরাধ। তাদের অপরাধ তারা তাদের ভোটের অধিকার ফেরত চেয়েছিল। এটাই তাদের অপরাধ।
জেলেখানায় মারা যাওয়া বিএনপি নেতা আবুল বাশারের স্ত্রী বলেন, আমি আমার স্বামী হারানোর বিচার চাই, আমার সন্তানকে এতিম করেছে, পুলিশ আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে- যার ফলে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।
যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাজিয়া বলেন, আমরা কোথায় যাবো। আমার স্বামীর মামলার বাদী পুলিশ, মামলা করলোও পুলিশ, সাক্ষীও দিলো পুলিশ- এটা কেমন বিচার। আদালতে বিচারকের সামনে এমন অবিচারের প্রতিবাদ করলে বিচারক বলে ‘এখানে আইনের কথা বলবেন না’।
কারাবন্দি বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের স্ত্রী রহিমা জাহান বলেন, আমার স্বামীকে চার বছরের জন্য জেল দিয়েছে, তার কোনো দোষ নাই, আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে- আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুক।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বোন শাহিদা মির্জা বলেন, আমার ছেলেকে না পেয়ে অসুস্থ স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তাকে নির্যাতন করেছে। আমার পরিবারের কেউ বাসায় থাকতে পারে না।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস বলেন, মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তারের সময় গাড়িচালককে নির্মমভাবে পিটিয়েছে পুলিশ। এরপর কয়েকদফা বাসায় ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা বাসায় গিয়ে চাঁদা চায়। বিএনপি করাই কি আমাদের অপরাধ। কারাবন্দি বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের স্ত্রী শিরিন সুলতানা বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ তাকে কারাগারে ডিভিশন দেয়নি। তবে বলবো এই সরকারের পরিণতি ভালো হবে না।
কারাবন্দি বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মেয়ে ব্যারিস্টার তাবাসসুম বলেন, আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত! তাকে প্রতিমাসে কেমোথেরাপি দিতে হয়। অথচ তাকে মুক্তি না দিয়ে জেলে ভরে রেখেছেন-আমার বাবার মুক্তি চাই।
গ্রেপ্তারকৃত যুবদল নেতা রানার মা বলেন, আমার ছেলে নির্দোষ। আমি ছেলের মুক্তি চাই। আমার ছেলের মুক্তি দেন। এ ছাড়া নির্যাতিত পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলীর স্ত্রী শিউলী বেগম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস মৃধার কন্যা আনিত, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবের স্ত্রী বেগম শাহনারা মায়া, বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবের স্ত্রী এডভোকেট শাহানা ইসলাম প্রমুখ।
সাংবাদিক নেতা কাদের গণি চৌধুরীর সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল হাই সিকদার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এলডিপি’র শাহাদাৎ হোসেন সেলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, ইউট্যাবের ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক লুৎফর রহমান, ড. আব্দুল করিম, ড. আবু জাফর, এসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এ্যাব এর প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু, মো. মোস্তাফা-ই জামান সেলিম, একেএম আসাদুজ্জামান চুন্নু, মাহবুব আলম, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) ডা. পারভেজ রেজা কাকন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. শামসুল আলম, অধ্যাপক মো. কামরুল আহসান, অধ্যাপক মো. নুরুল ইসলাম প্রমুখ।