হরতাল-অবরোধে বাড়ছে উদ্বেগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪৯ অপরাহ্ণ
করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এখনো ধুঁকছে গোটা বিশ্ব। ডলারের উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতিতে টালমাটাল অর্থনীতি। বৈশ্বিক প্রভাব বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে বাংলাদেশও। রিজার্ভে টান, রপ্তানি আয়ে ভাটার পাশাপাশি নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে হরতাল-অবরোধ। জ্বালাও-পোড়াও আতঙ্কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোতে আসছেন না বাইরের ক্রেতা। সব মিলিয়ে তিনদিনেই অনেকটা স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য।
পুরান ঢাকার পাইকারি বাজার, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ফুটপাতের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিক্রি বা অর্ডার কমেছে ৯০ শতাংশের বেশি। কোথাও আতঙ্ক নিয়ে দোকান খুললেও বিক্রি একেবারেই কম। শো-রুমে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সাধারণত দেশে হরতাল-অবরোধ হলে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দোকানপাটে কমে যায় বেচা-বিক্রি। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য সারাদেশে পৌঁছাতে পারেন না। সে কারণেও বিক্রিতে ভাটা পড়ে। আবার ক্রেতারাও ঝুঁকি নিয়ে পণ্য কিনতে বের হতে চান না।
হরতাল-অবরোধ হলে পরিবহন সংকটে বিভিন্ন বন্দরে আটকে পড়া কাঁচামালও সংগ্রহ করতে পারে না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাহত হয় উৎপাদন। যার প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানিতেও। পাশাপাশি পরিবহন ব্যবসায়ীদের ক্ষতিও কম নয়। তাদের আয়ের উৎসটাই পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সমস্যায় পড়েন ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। কারণ, বেশিরভাগ হরতালেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। ফুটপাত ও পাড়া-মহল্লায় মানুষের আনাগোনা থাকে কম।
হরতালের পর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা তিনদিনের অবরোধের মধ্যে প্রথম দুদিন ঢাকা শহরজুড়ে এমনটা দেখা যায়। রাজধানীর প্রধান ব্যবসা অঞ্চল পুরান ঢাকার নবাবপুর, চকবাজার, মৌলভীবাজার, বাবুবাজার, শাঁখারীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেনাবেচায় ভাটা পড়েছে। কিছু বাজারে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই। আবার অনেক বাজারে বেশকিছু সংখ্যক দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়।
এর মধ্যে মৌলভীবাজার ও চকবাজার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি ব্যবসার সবচেয়ে বড় জায়গা। ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা, গুঁড়া দুধের মতো নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, প্রসাধনী, রং, গহনা, ব্যাগ, জুতা ও কাপড়ের ব্যবসায় স্বাভাবিক দিনে এখানে সবচেয়ে জমজমাট। প্রতিদিনই ঢাকাসহ অন্য জেলার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য কিনতে মৌলভীবাজার ও চকবাজারে আসেন। লেনদেন হয় হাজার কোটি টাকা। তবে এ অবরোধে বেশ ফাঁকা ছিল এলাকাটি। হাজারখানেক দোকানের মধ্যে অনেক দোকান দেখা যায় বন্ধ।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. বশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমনিতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে এ হরতাল-অবরোধ আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। ওই যুদ্ধের খারাপ ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। নতুন করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা কীভাবে স্বাভাবিক কেনাবেচা করবেন। সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। আমরা এ অবস্থা মেনে নিতে পারছি না। দোকান খুলতে পারছি না। চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে এ অবস্থা যাচ্ছে।’
বশির উদ্দিন বলেন, ‘এখন ৫ শতাংশ ক্রেতাও পাইকারি এসব বাজারে নেই। আসবে কীভাবে? রাস্তাঘাট বন্ধ প্রায়। ঝুঁকি নিয়ে কেন কেনাকাটা করতে আসবে? আমরাও দেশের কোনো এলাকায় পণ্য পাঠাতে পারছি না।’
ওই বাজারে এসএম ট্রেডার্সের একজন মনিহারি ব্যবসায়ী বকুল হোসেন বলেন, ‘হরতালে বিক্রি হয়নি। অবরোধেও কিছু বেচাকেনার আশায় দোকান খুলে বসে আছি। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। বাইরের ক্রেতা ঢাকায় ঢুকতে না পারলে পাইকারি বেচাকেনা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাইরের অর্ডারও আসছে না। ট্রান্সপোর্টের গাড়ি বন্ধ। আগের অর্ডারের মাল পাঠাতে পারছি না। এভাবে চললে আমাদের ক্ষতি বাড়বে।’
শুধু পুরান ঢাকা নয়, ব্যবসায় অচলাবস্থা সবখানেই শুরু হয়েছে। দুপুর ২টায় রামপুরা এলাকায় গৃহস্থালি পণ্যের ব্র্যান্ড মিয়াকোর ডিলার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পুরো সকাল গেলো বিক্রিবাট্টা হয়নি। করোনা গেলো, এরপর যুদ্ধ। এখন হরতাল-অবরোধ শুরু হলো। তাহলে আমরা ব্যবসা করবো কখন।’
ওই এলাকায় অ্যাপেক্সের স্টোর ম্যানেজার বাশার গাজী বলেন, ‘আমাদের বিক্রিও অনেক কমেছে। ক্রেতা আসছে না। আসলে কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না।’
ওয়ালটন প্লাজার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমাদের গাজীপুরের সেলস সেন্টারে আগুন দেওয়া হয়েছে। কোটি কোটি টাকার পণ্য নিয়ে আমরা উদ্বেগের মধ্যে ব্যবসা করছি। অনেক সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ব্যবসায়ীরা আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। এটা খুব খারাপ বিষয়।’
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার সম্পূর্ণ বন্ধ দেখা যায়। ওই এলাকায় খালেক স্টোরের দোকানি এনামুল বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের কারণে বিক্রি কমে গেছে। এ এলাকা সহিংস হয়ে উঠেছিল হরতালে। পাশের বটতলায় মোটরবাইকে আগুন দেওয়া হয়। ভয়ে দোকান খোলা যাচ্ছে না। একটি শার্টার খুলে পরিচিতদের মধ্যে বেচাকেনা করছি।’
সেখানে ফুটপাতের চা বিক্রেতা জহির বলেন, ‘আগে প্রতিদিন সাত থেকে নয় হাজার টাকার কেনাবেচা হতো, এখন তা কমে এসেছে তিন হাজারে। দোকান খরচ বাদে এখন সংসারে নেওয়ার মতো কিছু থাকছে না। এমন হলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে বাকি থাকবে না।’
রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে। যারা এমন উদ্বেগের রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছেন, সেটা ঠিক নয়। কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দলকে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। যে কর্মসূচি অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেটা আমাদের প্রত্যাশিত নয়।’
মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা চাই বিগত কয়েক বছরের মতো শান্তিপূর্ণ ধারায় আন্দোলন হোক। ব্যবসায়ীরা সব সময় শান্তিপূর্ণ অবস্থা আশা করে। তবেই দেশের অর্থনীতির চাকা চাঙা থাকবে।’
জাগো নিউজ