জীবন যুদ্ধে অসহায় মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৩, ৩:৩৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
রহমত উল্লাহ। চেহারায় বয়সের ছাপ। তিনি একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। স্ত্রী-তিন সন্তান নিয়ে সংসার তার। ১৭ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করেন। সন্তানরা ঢাকায় স্কুলে পড়াশোনা করে। মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পান। এই বেতন দিয়ে টেনেটুনে চলে তার সংসার। রহমতের বাড়ি চাঁদপুরে। দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও বেতন বাড়েনি তার।
সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। রাজধানীর তেজতুরী বাজারে এক রুম ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গুটিসুটি বেঁধে রয়েছেন। সাড়ে ৮ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয় তাকে। এর আগে তিনি দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। সেখানে ভাড়া গুনতে হতো ১৬ হাজার টাকা। অন্যদিকে রয়েছে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ। খরচ সামলাতে না পেরে তার এক ছেলেকে স্কুল থেকে এনে ভর্তি করিয়েছেন মাদ্রাসায়।
রহমত উল্লাহ বলেন, এই শহরে মনে হচ্ছে আর টিকে থাকা হবে না। আয় বাড়ছে না কিন্তু দিনদিন ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। এদিকে বাবা হয়ে ছেলে-মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে বসেও থাকতে পারছি না। গ্রামে গিয়ে কিছু একটা করবো সেই সুযোগও নেই। নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়তি। যাতায়াত খরচ তো আছেই। আগে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতাম। এখন স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ছোট একটি রুমের মধ্যে থাকি। এখানেও সাড়ে ৮ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। অন্য বিল তো আছেই। মাছ, মাংসের কথা বাদই দিলাম একটা ডিম খেতে পারছি না। পুষ্টিকর খাবার খেতে না পারলে তো আরও কঠিন অসুখে ভুগতে হবে। আর্থিক সংকটের কারণে মেজো ছেলেটাকে স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছি। টিউশনি ছিল ওদের সেটিও তিন মাস আগে বাদ দিয়েছি। এভাবে সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলে এই ঢাকায় আর টিকতে পারবো কিনা জানি না। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য কতোটুকু আলো এনে দিতে পারবো সেটিও এখন অজানা।
শুধু রহমত উল্লাহ নয়, জীবিকার তাগিদে অনেকে ছুটে আসেন এই শহরে। প্রতিদিন শত শত মানুষ নামেন বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট ও রেলস্টেশনে। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বেকার যুবকরা ছুটে আসেন এই কর্মব্যস্ত নগরে। ছোট বড় বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন তারা। আবার কাজের খোঁজে রাতদিন হন্যে হয়ে ঘুরছেন অনেকে। হাজার হাজার পরিবার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন এই ইট পাথরের নগরে। অর্থনৈতিক সংকট আর নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে অনেকে পরিবার নিয়ে ঢাকাও ছেড়ে যাচ্ছেন। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। শুধু মাছ, মাংস, তেল নয়, প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে পারছে না অনেকে। নানামুখী সংকটে জীবন পার করছেন মানুষ। এদিকে সিন্ডিকেটে জিম্মি বাজার।
আঁখি আক্তার কয়েক দিন আগে ঢাকা ছেড়ে পাড়ি জমান গ্রামের বাড়িতে। তার স্বামী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। দুই মাস আগে তার স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলাম ঢাকায়। ৯ বছর ঢাকার জীবন ছিল। মিরপুরে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে ভাড়া থাকতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার সন্তানদের নিয়ে চলে আসতে হলো গ্রামে। বড় মেয়ে মিরপুরের একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। আমার স্বামীর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরে আবার অফিস করা শুরু করে। কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে কোনো ভাবে টিকে থাকতে পারিনি। চিকিৎসা খরচ থেকে শুরু করে সবকিছু সামলানো অনেক কষ্টের ছিল।
একদিকে বাসা ভাড়া বাড়তি অন্য দিকে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এদিকে বাচ্চাদের খরচ তো ছিলই। যে টাকা বেতন পেতো তা মাসের ২০ দিন হলেই শেষ হয়ে যেতো। বাচ্চাদের একটু ভালোমন্দ খেতে দিতে পারতাম না। বাজারে গেলে দু-একটা জিনিস কিনলেই সব টাকা শেষ হয়ে যেতো। অনেক সময় প্রয়োজনীয় জিনিসও না কিনে ফিরে আসতে হতো। এই মাসের ৫ তারিখে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। এখানেও হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু বাসা ভাড়ার টাকা দিতে হবে না। এমন অবস্থা হয়েছিল ঢাকায় থাকলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতো।
আলী হোসেন বলেন, দশ বছর ধরে ঢাকায় থাকি এই রকম পরিস্থিতি কখনো যাইনি। একটা ব্যবসা করতাম সেটিও ছেড়ে দিয়েছি। স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে ফার্মগেটের একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। গত চার মাস হলো বাসা ছেড়ে দিয়েছি। স্ত্রী ও সন্তানকে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী পাঠিয়ে দিয়েছি। মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতো। বাজারে গেলে মনে হতো কিছুই কিনতে পারছি না। এদিকে তিন মাসের ভাড়া বাকি ছিল। সন্তানের বাড়তি খাবার দুধ কিনতে পারতাম না। বর্তমানে যেখানে যে সুযোগ পাচ্ছি সেই কাজ করছি। অর্থ সংকটে কমিউনিটি সেন্টারে থাকি। স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মাকে আয় কম থাকলেও টাকা পাঠাতে হয়। ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে ঢাকায় পড়াশোনা করাবো কিন্তু জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়েছি। যদি কখনো সুযোগ হয় আবার তাদের ঢাকায় নিয়ে আসবো।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রাজু। মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার ফার্মগেটে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। রাজুর স্ত্রী মানসুরা বলেন, গত এক বছর ধরে এখানে ভাড়া থাকি। আগের চেয়ে ভাড়া বেড়েছে। বিলও অনেক আসে। ১৭ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। মাসের ১৫ দিন আসলে টাকার হিসাব মেলাতে পারি না। একদম হাত খালি হয়ে যায়। গ্রামে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আছে তাদের মাসে মাসে খরচ পাঠাতে হয়। আজও বাজারে গিয়ে ২৫০০ টাকা খরচ হয়েছি কিন্তু কিসে খরচ করেছি মেলাতে পারছি না। মনে হচ্ছে শুধু টাকাই খরচ করেছি প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস কিনতে পারিনি।
সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক খাবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ঈদে গরুর মাংস খেয়েছি এরপর আর খাওয়া হয়নি। ডিমের দাম একটু নাগালের মধ্যে ছিল সেটিও বাদ দিতে হয়েছে। কম দামের শাক-সবজি খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। কোনো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছি না। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা তারাও ভালোমন্দ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। দুপুরে মাছ বা মাংস থাকতো এখন ডাল আর সবজি দিয়ে খেতে হচ্ছে। এমন সংকটে দিন পার করা সত্যিই কষ্টকর। আগে ১ হাজার টাকায় যে বাজার করতাম এখন সেটি চোখেও দেখতে পাই না। সপ্তাহে সপ্তাহে প্যাকেটজাত পণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কীভাবে বাঁচবে মানুষ?
মানবজমিন