ত্রিমুখী সংকটে সুনামগঞ্জের কৃষকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২২, ৩:০৯ অপরাহ্ণ
সুনামগঞ্জের কৃষকদের ত্রিমুখী সংকট শুরু হয়েছে। একদিকে ফসল রক্ষা বাঁধ, পাহাড়ি ঢল থেকে কাঁচা ধান রক্ষা করা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটার আহ্বান। আবহাওয়ার আগাম বার্তার পর এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা প্রায় চার লাখ মানুষ।
গত কয়েক দিনের পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যায় সুনামগঞ্জের মানুষের ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষায় আপ্রাণ লড়াই করছেন। ফাটল ও ধসের কবলে পড়া অনেক বাঁধের ভাঙন ঠেকানো গেলেও কিছু বাঁধ ভেঙে কৃষকদের কাঁচা ধান ডুবে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার হাজারো কৃষক।
ফাটল ধরা যে বাঁধগুলো এখনো টিকে রয়েছে, সেগুলোয় কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। কত দিন পর্যন্ত এ রকম লড়াই করে বাঁধ রক্ষা করবেন তারা, সে প্রশ্ন তাদের কাছে অজানা।
এদিকে গত রোববার (১০ এপ্রিল) আবহাওয়া অফিস থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। সে খবরে কৃষকের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না। বলা হয়েছে, ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত উজানের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত হবে। এতে এখন পর্যন্ত জেলার সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও এ কয়েক দিনে বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। এক দিকে জমিতে কাঁচা ও আধাপাকা ধান, অন্যদিকে ধান কেটে ফেলার আহ্বান। এমন খবরে দিশেহারা কৃষক।
তাহিরপুরের বড়দল গ্রামের বাসিন্দা বদরুল ইসলাম বলেন, মাটিয়ান হাওরে ১ কেয়ার (৩০ শতাংশে ১ কেয়ার) জমি করেছি। এই জমি করতে গিয়ে ৮০ থেকে ৯০ হাজার ঋণ করেছি। ঋণের অর্ধেক টাকা ধানের ওপর মহাজনের কাছ থেকে নিয়েছি। আর অর্ধেক সুদের ওপর। বৈশাখে ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দুই ছেলে-মেয়ে আমার। জমির ফসল থেকে সারা বছর খরচের টাকা জোগাড় হয়। আজ ১ সপ্তাহ বৃষ্টিপাতের খবর পেয়েছি। এমনিতেই আমাদের বাঁধ নড়বড়ে। কয়েক দিন ধরে মানুষকে নিয়ে বাঁধে কাজ করছি। এখন আল্লাহ ভরসা।
তাহিরপুরে বর্ধিত গুরমা হাওরে ২৪ কেয়ার জমি করেছেন সুলেমানপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. রফিকুদ্দিন। ৪ ছেলে-মেয়ে নিয়ে শ্রম-ঘাম দিয়ে বছরের একমাত্র অবলম্বন হাওরে বোরো ধান চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমি প্রায় ২ হার (১২ কেয়ারে ১ হাল) জমি করেছি। অনেক টাকাপয়সা খরচ হয়েছে। এখন যদি ধান না কাটতে পারি, বউ-বাচ্চা নিয়ে উপোস থাকতে হবে। হাওরের কিছু হলেই ২ টাকার মাল ১ টাকা হয়ে যাবে। তাই গরু-বাছুরও বিক্রি করতে পারব না।
তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুরের পাটাবুকার গ্রামের বাসিন্দা মো. আনারুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন ধরে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে কাজ করছি। এখন যে রকম খবর আসছে, তাতে আমাদের ভয় হচ্ছে। এ রকম যদি হয়, তাহলে সামনে আমাদের দুঃখের দিন আসতেছে। এলাকায় কোনো কাজ পাব না। বাড়ি-ঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় কাজ খুঁজতে হবে।
এদিকে ১৩ থেকে ১৭ এপ্রিল মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের খবর শুনে অনেক কৃষক আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। সোমবার (১১ এপ্রিল) তাহিরপুরের শনির হাওরে দেখা গেছে, অনেক কৃষক শ্রমিক লাগিয়ে ধান কাটছেন। তারা ভয় আর শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, এখনো নদীর পানি ভরপুর। যদি মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া বাঁধ আর রক্ষা করা যাবে না। এর থেকে আধাপাকা ধান কাটাই ভালো।
এ বিষয়ে বালিজুড়ি ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা রিপন হাসান বলেন, ২০ জন শ্রমিক দিয়ে ৫ কেয়ার জমির ধান কাটছি। অনেকে শ্রমিক পাচ্ছে না ধান কাটতে। আমাদের হাওরের অবস্থা খুব খারাপ। আকাশের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। এ সময় বাঁধের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বৃষ্টি হলে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। তাই কাঁচা ধান কেটে ফেলছি।
একই কথা বললেন কৃষক তৌফিক মিয়া, মো. আব্দুল কাদির, হোসেন আলী ও মো. কামাল মিয়া। সবাই জমির ধান কাটতে ব্যস্ত।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ১৩ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবং পুরো মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে যদি ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে আমাদের এখানে একসঙ্গে দুই মিটার পানি বেড়ে যায়। অনেক জায়গায় বাঁধে পানি ছুঁইছুঁই করছে। পানি যদি প্রবল বেগে আসে, তাহলে অনেক জায়গায় উপচে পানি যাবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন। আমরা আশা করছি, আল্লাহ আমাদের এ যাত্রায় রক্ষা করবেন।
তিনি আরও বলেন, যে জমির ধান ৮০ ভাগ পেকে গেছে, সে জমির ধান দ্রুত কেটে ফেলতে হবে। ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন রয়েছে। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক শ্রমিক এসে গেছেন। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে আরও শ্রমিক আসবেন।
এরপরও আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা কৃষকদের পাশে রয়েছেন। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সবাই বাঁধ রক্ষার কাজে যুক্ত হোন।