তেল নিয়ে তেলেসমাতি নেপথ্যে কারা?
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০২২, ১২:৪৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
দেশের বাজারে ভোজ্য তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে দাম। একই অজুহাতে বাজারে তেলের সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরবরাহের ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যেই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড গড়েছে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যটিতে। দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ ভোক্তাদের। এমন পরিস্থিতিতে আরেক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বোতলজাত সয়াবিনে লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে ভোজ্য তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
মূল্য বৃদ্ধির এই ঘোষণায় নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে বাজারে।
গতকাল কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, দোকানে খোলা তেল নেই বললেই চলে। অথচ নিম্ন আয়ের মানুষ সাধারণত খোলা তেলই ক্রয় করে থাকেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে খোলা তেল বিক্রি করা যচ্ছে না। এতে তারা লাভ করতে পারছেন না। বেশি দামে বিক্রি করতে গেলে আবার ভোক্তা অধিকারের জরিমানায় পড়তে হয়। তাই আপাতত খোলা তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা। এ অবস্থায় বোতলের তেল খুলে লুজ হিসেবে বেশি দামে বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
সরজমিন রাজধানীর কাওরান বাজার, বাসাবো, মাদারটেক, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেটসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, অনেক দোকানেই খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করা হচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, আগের কেনা তেল শেষ হয়েছে। নতুন করে মজুত করা হয়নি। তেলের দামে অস্থিরতা চলছে। ক’দিন পরপরই পাইকার থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সরকারের দামের সঙ্গে মিলিয়ে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য নতুন করে খোলা সয়াবিন কিনছেন না ব্যবসায়ীরা।
কাওরান বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, সরকারের দরের চেয়ে বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম অনেক বেশি। মিল থেকে বাজারে কম দামে সাপ্লাই দিলে বাজার নেমে যাবে। কিন্তু তারা বেশি দামে বিক্রি করছে। তাদের থেকে কিনে আমাদের সরকারি দামে বিক্রি সম্ভব না। এজন্য দু’দিন ধরে তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছি। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বোতলে লাভ হয় কিছুটা। খোলায় কোনো লাভই নাই। এক সপ্তাহ ধরে খোলা তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছি। গতকাল দুইটা দোকানে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য। কিন্তু আমাদের বেশি দামে কিনে সরকারি দামে বিক্রি করলে অনেক লস হচ্ছে।
রাজধানীর অন্যান্য খুচরা বাজারে দেখা যায়, কেজিতে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা পর্যন্ত খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। পাইকার থেকে তাদেরকে ১৮০ থেকে ১৮৩ টাকা পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে বলে জানান তারা। আর লিটারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকায়। পাইকারিতে যা তারা ১৬২ টাকায় ক্রয় করেন। অন্যদিকে বোতলের তেল খুলে লুজ হিসেবে বিক্রি করছেন অনেকে। হিসাব করে দেখা যায়, বোতলের তেল কেজিতে ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১৭৬ টাকা। অথচ বোতল খুলে এই তেল ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে অনেকেই খোলা তেল বিক্রি বন্ধ রেখে বোতল কেটে বিক্রি করছেন।
বাসাবো বাজারের সিটি গ্রুপের তীর সয়াবিনের ডিলার রাতুল বলেন, আমাদের বোতলজাত তেল খুলে বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এজন্য আমরা নতুন করে তেল আনা বন্ধ রেখেছি। ফোরকান স্টোরের মালিক বলেন, খোলা তেলের দাম অনেক বেশি। তাই সবাই বোতলের তেল কিনছেন। ডিলাররাও আমাদের পর্যাপ্ত তেল দিচ্ছে না। ২০ লিটার অর্ডার দিলে ৫ লিটার দেয়। মাদারটেক বাজারে ১৮৫ টাকা করে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন মাদারীপুর স্টোরের হেলাল সিকদার। তিনি বলেন, আমরা যেমন দামে কিনি তেমন দামে বিক্রি করি। আমাদের ১৮০ টাকার উপরে সয়াবিন তেল কেনা পড়ে যায়। তাহলে এর কম আমরা বিক্রি করবো কীভাবে। বিক্রি না করেও পারছি না। কাস্টমার চাল, ডাল এক দোকান থেকে কিনে তেল কিনতে তো অন্য দোকানে যাবে না।
রোববার পর্যন্ত পাইকারিতে ১৪৭ টাকা কেজি দরে সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে বলে জানান, বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা। তিনি মানবজমিনকে বলেন, খুচরায় কেন এত বেশি দামে বিক্রি করছে বলতে পারছি না। এর জন্য কালকে কাওরান বাজারে অনেককে জরিমানা করছে। এখন কয়েকটা মিলে তেল নেই। এ জন্য বাজারে সরবরাহ কম। আমাদের যে চাহিদা সে অনুযায়ী মাল এখনো আসেনি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম চড়া। তেল আনার জন্য যে ভ্যাট দিতে হয় তা কমানো হলে দাম কিছুটা কমবে। তাছাড়া এখন দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নাই।
বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বোতলজাত তেলে লিটারপ্রতি আরও ১২ টাকা বাড়ানোর ঘোষণার ব্যাপারে তিনি বলেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের প্রেক্ষাপটে দাম বাড়াতে হবে। নইলে তারা মাল আমদানি করবে না। এখন জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। করোনার আগে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম প্রতিটনে ৭১৫ ডলার ছিল। এখন ১৭০০ ডলারের উপরে হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, জাহাজও সীমিত। এসব নানা কারণে তেলের দাম বাড়ছে।
সর্বশেষ গত ৬ই ফেব্রুয়ারি লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয় ভোজ্য তেলের দাম। রোববার আরও ১২ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন। যা আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলেন তারা। শুধু বোতলজাত সয়াবিন নয়, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে খোলা সয়াবিনের নির্ধারিত দর লিটারপ্রতি ১৪৩ টাকা, যা তারা ১৫৭ টাকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া পাম সুপার তেল ১৪৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের বোতলের নির্ধারিত দর ৭৯৫ টাকা থেকে ৮৭০ টাকা নির্ধারণের কথা জানায় ব্যবসায়ীরা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। অথচ এক বছর আগেই এই তেলের দাম ছিল ১২৫ থেকে ৩০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৩১.৩৭ শতাংশ। বর্তমানে লুজ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটারে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। যা গত বছর ছিল ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই দাম বেড়েছে ৪৪.১ শতাংশ। পাম তেলের (লুজ) বর্তমান মূল্য ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ১০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই দাম বেড়েছে ৫২.৫ শতাংশ। এছাড়া পাম তেল (সুপার) বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা। যা গত বছর ছিল ১০৪ থেকে ১০৫ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫৩.১১ শতাংশ।