চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি-এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের। তাদের মতে, যুদ্ধের ডামাডোলে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য একশ মার্কিন ডলারে উঠেছে। কয়েকগুণ বেড়েছে এলএনজি গ্যাসের মূল্য। বেড়েছে সারের মূল্যও। উচ্চমূল্যে এসব পণ্য সরকারকে কিনতে হবে। পাশাপাশি দেশের গমের মোট চাহিদার অর্ধেক আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের কারণে গমসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে ব্যবসায়ীরা। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর দাম বেড়ে গিয়ে চাপের মুখে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। তবে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন প্রভাব পড়বে না। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেনে খুব বেশি পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয় না।
তাদের আরও অভিমত-যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদের হলে এর নেতিবাচক প্রভাব গভীর হবে। এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝাঁকুনি পড়তে শুরু করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ নিয়ে বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়গুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলেছে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চলবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন নির্মাণ করছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ প্রতিষ্ঠানটি পড়লে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার করা হয়নি। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ রাশিয়ার সঙ্গে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য রয়েছে, তা চলমান থাকবে। তবে এরই মধ্যে বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি দেশের শেয়ারবাজার নিম্নমুখী। বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থা সারা বিশ্বেই বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল। দেশে বছরে গমের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এ গম প্রক্রিয়াজাত করে ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বেড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েছেন। ফলে এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত আছে। পণ্যের এলসি ও শিপমেন্টও বন্ধ রাখা হয়েছে। তিন দেশের আমদানি ও রপ্তানিকারকরা জরুরি ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরু হওয়ার দিন থেকেই ব্যবসায়ীদের এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দেশে আমদানিকারকদের বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মূল কারণ ওই দুদেশ থেকে পণ্যবোঝাই করতে কোনো দেশের জাহাজ মালিক এ মুহূর্তে রাজি নয়। তারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বাজেটে ৪৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ধরা হয়েছে। এটি এখন ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এটি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সার, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এগুলো আমদানি করতে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকির অঙ্ক। ক্রমেই চাপে পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতি।
জানতে চাইলে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। তেলের মূল্য আগেই বেড়ে ছিল। এখন আরও বেড়েছে। এখন সরকারকে উচ্চমূল্যে তেল কিনতে হবে। গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। বেড়েছে সারের মূল্যও। রাশিয়া থেকে গম আমদানি করা হয়। সেটির দামও বেড়েছে। রাশিয়ার ওপর দিয়ে জাহাজ ও বিমান চলতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের বিকল্প বাজার ও রাস্তা ব্যবহার করে পণ্য আনতে হবে। করোনার কারণে জাহাজ ভাড়া আড়াইগুণ বেড়েছিল। যুদ্ধের কারণে আরও বাড়বে। বাড়বে বিমান ভাড়াও।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানির পয়েন্ট থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। আমদানির ক্ষেত্রে তুলা, গমসহ কিছু পণ্য আনা হয়। এখন এসব পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।
রাশিয়ার সম্পদ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও পণ্য পরিবহণের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের বাণিজ্যে কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। কারণ নিউক্লিয়া সংক্রান্ত পণ্য রাশিয়া থেকে আনা হচ্ছে। পণ্য পরিবহণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তবে যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের চাপের মধ্যে ফেলবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধরত দেশ রাশিয়ায় গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। একইভাবে ইউক্রেনে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি রয়েছে।
জানতে চাইলে বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য কম। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যাঘাত হবে না। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়তে পারে আমাদের ওপরও। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। আমাদের আগে এক দফা জ্বালানির দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব বুঝতে পেরেছি। এখন যদি যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয় আরও কঠিন অবস্থা দাঁড়াবে। জ্বালানিনির্ভর সবকিছুর মূল্য বেড়ে যাবে।
জানা গেছে, গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্ব যত গম রপ্তানি করে তার প্রায় ৩০ শতাংশ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টার প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চলতি মৌসুমে গম ও ভুট্টার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এসব পণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়বে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দামও বেশ চড়া।
সূত্র : যুগান্তর