সিলেটে চোখ বন্ধ বুদ্ধিমান ক্যামেরার, দায় নিচ্ছে না কেউ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৩:১৭,অপরাহ্ন ১১ জানুয়ারি ২০২২
শুক্রবার সকালে নগরীর টিলাগড় এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ভাটাটিকরের যুবক সাহাদ আকরাম খান রাহি (২৬)। শুক্র ও শনিবার হন্যে হয়ে খুঁজার পরও তার সন্ধান না পাওয়ায় পুলিশের শরণাপন্ন হন তার পরিবার। শাহপরাণ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। পরিবারের ধারণা ছিলো, টিলাগড় এলাকায় থাকা ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ক্যামেরায় হয়তো নিখোঁজ রাহির গতিবিধি ধরা পড়তে পারে। কিন্তু তাদের সেই আশা ভঙ্গ হয় তখন, যখন তারা জানতে পারেন টিলাগড় এলাকায় স্থাপনকৃত ৪টি ক্যামেরাই অচল। শুধু রাহির পরিবারই নয়, আইপি ক্যামেরা অকেজো থাকার কারণে প্রতিদিনই নানাভাবে আশাহত হচ্ছেন নগরীর ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্প’র আওতায় সিলেট নগরীতে বসানো বুদ্ধিমান ক্যামেরাগুলোর ৬০ শতাংশই অকেজো হয়ে গেছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। ক্যামেরা স্থাপনের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) দাবি, তারা সচল অবস্থায় পুরো সিস্টেমটি হস্তান্তর করেছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) কাছে। পুলিশেরই এটি তদারকির দায়িত্ব। কিন্তু এসএমপি’র দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিজেই জানেন না যে, তার অধীনেই রয়েছে এই ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীনে শুরু হয় ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি’ প্রকল্পের কাজ। ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যায়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের আওতায় সিলেট নগরীতে ‘আইপি ক্যামেরা বেইসড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’ স্থাপন, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অটোমেশন এবং নগরীর ৬২টি পয়েন্টে ১২৬টি ফ্রি ওয়াইফাই জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৯ সালের ২৭ জুলাই প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্পের আওতায়, ‘আইপি ক্যামেরা বেইসড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১১০টি আইপি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে অপরাধীর চেহারা সনাক্তকরণের জন্য ১০টি এফআর (ফেস রিকগনিশন) ক্যামেরা এবং যানবাহনের নম্বরপ্লেট সনাক্তের জন্য ১০টি এনপিআর (অটো নাম্বারপ্লেট রিকগনিশন) ক্যামেরা রয়েছে। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। পুরো সিস্টেমটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এসএমপিকে। ১২ জন পুলিশ সদস্য পুরো নগরীতে নজরদারির জন্য বিসিসি থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। কোতোয়ালি থানার দ্বিতীয় তলা থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পুরো শহরের বুদ্ধিমান ক্যামেরা। দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে এসএমপি’র হেডকোয়ার্টার্স শাখা। বর্তমানে কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে আছেন ৫ পুলিশ সদস্য। ২০২১ সালের ৬ জানুয়রি ‘আইপি ক্যামেরা বেইসড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’টি এসএমপিকে হস্তান্তর করে বিসিসি। কিন্তু এর আগেই নষ্ট হয়ে যায় নগরীর ৭টি বুদ্ধিমান ক্যামেরা। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ১১০টির মধ্যে বর্তমানে সচল রয়েছে ৪৩টি ক্যামেরা। মাত্র এক বছরে অচল হয়ে গেছে ৬৭টি আইপি ক্যামেরা। শাহজালাল (রহ.) মাজারের নজরদারিতে থাকা ক্যামেরাগুলো মাসের পর মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চৌহাট্টা পয়েন্টে কোনো ক্যামেরাই নেই।
এসএমপিসূত্রে জানা যায়, নগরীর আম্বরখানায় ৪টি, জিন্দাবাজারে ৪টি, টিলাগড়ে ৪টি, মেন্দিবাগে ৪টি, দক্ষিণ সুরমার মুক্তিযোদ্ধা চত্ত্বর এলাকায় ৪টি করে আইপি ক্যামেরা বসানো থাকলেও, এগুলোর একটিও সচল নয়। নগরীর বাগবাড়ি এলাকায় ৩টি, রেল স্টেশন, সুবিদবাজার, নাইওরপুল, কুমারপাড়া, লাক্কাতুরা, শাহজালাল মাজার, উপশহর ই-ব্লক (এসএমপি হেডকোয়ার্টার রোড) ও নয়াসড়ক এলাকায় বসানো হয়েছে ৩টি করে ক্যামেরা। এগুলোর সবকটিই দীর্ঘদিন যাবত অচল হয়ে পড়ে আছে। এই এলাকাগুলোতে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত কোনো সচল ক্যামেরাই নেই। এছাড়া, এয়ারপোর্ট রোড, বাগবাড়ি এলাকার বর্ণমালা পয়েন্ট, আখালিয়ার বিজিবি গেইট, কিন ব্রিজ, শাহী ঈদগাহ, শাহজালাল ব্রিজ, হুমায়ুন চত্ত্বর এলাকায় ২টি করে এবং উপশহর এবিসি পয়েন্ট, পূর্ব শাহী ঈদগাহ, রিকাবীবাজার ও আখালিয়া সুরমা এলাকায় ১টি করে আইপি ক্যামেরা অচল হয়ে রয়েছে। চৌহাট্টা পয়েন্টে দুটি ক্যামেরা থাকার কথা থাকলেও, একটিও বসানো হয়নি। ফলে, কন্ট্রোল রুমে বসে ওই সকল এলাকায় নজরদারি করতে পারছে না পুলিশ। এই ৬৭টি অচল ক্যামেরাকে সচল করতে গ্রহণ করা হচ্ছে না কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ।
সচল থাকা ৪৩টি ক্যামেরার মধ্যে রয়েছে নগরীর মির্জাজাঙ্গালে ৩টি, ব্লু বার্ড স্কুল এন্ড কলেজ রোডে ২টি, কজলশাহ এলাকায় ইস্কন মন্দির রোডে ১টি, জেল রোডে ৩টি, জল্লারপারে ২টি, শেখঘাট জিতু মিয়ার পয়েন্টে ৩টি, কাজিরবাজার ব্রিজে ২টি, লামাবাজারে ৩টি, মেজরটিলায় ২টি, মিরের ময়দানে ২টি, বন্দরবাজারে ৪টি, রিকাবীবাজারে ৪টি, শিবগঞ্জ পয়েন্টে ৩টি, সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে ৩টি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গেইটে ২টি, মদিনা মার্কেটে ২টি এবং আখালিয়া সুরমা এলাকায় ২টি ক্যামেরা। চলমান নগর উন্নয়ন কাজে এই ক্যামেরাগুলোর মধ্যেও কয়েকটি যে কোনো সময় অচল হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশসূত্র।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ ক্যামেরা নষ্ট থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এটা আইসিটি বিভাগ থেকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আইসিটি শাখায় যোগাযোগ করলে বিস্তারিত জানতে পারবেন। ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় কন্ট্রোল রুম থেকে ঠিকমতো নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। কমিশনার স্যারকে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সত্যজিৎ রায় দাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি এই প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আইসিটি শাখার প্রোগ্রামারের সাথে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন।
কথা হয় জেলা প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত প্রোগ্রামার শ্যামল চন্দ্র দাসের সাথে। তিনি বলেন, এখানে আমাদের তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, আমরা একই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ, কিন্তু কার্যক্রম আলাদা। বিসিসি এবং এসএমপি এই প্রকল্পের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাদের সাথে কথা বললেই ভালোভাবে জানতে পারবেন।
আইপি ক্যামেরার তদারকির দায়িত্বে থাকা এসএমপি’র হেডকোয়ার্টার্স শাখার উপ-কমিশনার মো. কামরুল আমীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিসিসি তো সিটি কর্পোরেশনকে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়ার কথা। আসলে কাগজপত্র না দেখে কিছুই বলা যাচ্ছে না। একদিন অফিসে আসেন, আমি কাগজপত্র দেখে বিস্তারিত বলতে পারব।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্প’র উপ-প্রকল্প পরিচালক মধুসূদন চন্দ একাত্তরের কথাকে বলেন, আমরা সচল অবস্থায় পুরো সিস্টেমটি এসএমপিকে হস্তান্তর করেছি। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের। আমাদের কাজ ছিলো শুধু এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা। ২০২১ সালের শুরুতেই ডিজিটাল সিলেট সিটি শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আমরা ‘আইপি ক্যামেরা বেইসড সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’টি এসএমপিকে হস্তান্তর করেছি। ক্যামেরাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বললে ভুল হবে। আসলে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং চলমান নগর উন্নয়ন কাজের জন্য ফাইবার ক্যাবলগুলো অনেক সময় কাটা পড়ে যায়। ফলে অচল হয়ে যায় ক্যামেরাগুলো। তবে, তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের উচিত ক্যাবল প্রতিস্থাপন এবং ক্যামেরাগুলো ঠিকঠাক আছে কি না খেয়াল রাখা। চুক্তিতে এটা পরিষ্কার ভাবে বলা আছে।’
ডিজিটাল সিলেট সিটি প্রকল্পের ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সিসিককে ফ্রি ওয়াইফাই এবং এসএমপিকে আইপি ক্যামেরার তদারকির দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে বিসিসি। দু-তিন মাসের মধ্যে ওসমানী হাসপাতালের অটোমেশনের কাজও সম্পন্ন হবে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে বলে জানান তিনি।
একাত্তরের কথা