বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ন অঞ্চল সিলেট: আজ একদিনেই প্রাণ গেল ৯ জনের
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৫৮:০৪,অপরাহ্ন ০৬ জুন ২০২০
নিজস্ব প্রতিবেদক :
শীর্ষস্থানে থাকাটা সব সময় যে গৌরবের হয় না, তার বড় প্রমাণ সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলার বজ্রপাত। সারা বিশ্বে মার্চ থেকে মে—এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই গবেষণা করা হয়েছে। গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন নাসার বিজ্ঞানী স্টিভ গডম্যান।
তবে শুধু সুনামগঞ্জ নয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত হয়। তাই দেশের মধ্যে ব্জ্রপাতের ঝুঁকি বেশি সিলেট বিভাগে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, বজ্রপাত হচ্ছে আবহাওয়া কেন্দ্রীয় দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক। বাংলাদেশে দুটি মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ‘প্রাইমারি সামার’। এপ্রিল-মে মাসজুড়ে এ মৌসুমের বিস্তৃতি। এসময়ে ভার্টিক্যাল ক্লাউড বা সম্ভু মেঘ থাকে বলে ঘন ঘন কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত হয়। এই ‘প্রাইমারি সামার’ মৌসুম এখন জলজ্যান্ত আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে আতঙ্কিত না হয়ে যতোটা সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিতে হবে। বজ্রপাতের ঘটনা এক বিভীষীকার নাম হয়ে ওঠেছে সিলেট বিভাগের মানুষের কাছে। আজ একদিনেই সিলেট বিভাগে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন নয় জন । শনিবার (৬ জুন) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বজ্রপাতে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ডোবায় মাছ ধরতে গিয়ে মঞ্জু মিয়া (২৫) নামের এক জেলে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। সে সেলবরষ ইউনিয়নের সলপ গ্রামের ফুলচান মিয়ার ছেলে।
শনিবার (৬ জুন) সকাল সাড়ে নয়টায় নিহতের বাড়ি সংলগ্ন ডোবায় এই ঘটনা ঘটে। সেলবরষ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নূর হোসেন মৃত্যুর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় বজ্রপাতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ শনিবার (৬ জুন) সকালে উপজেলার পৃথক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, উপজেলার গল্লাসাংগন (পালইআলা বাড়ি) গ্রামের মৃত ইসহাক আলীর ছেলে আব্দুল মতিন কুটু (৬০) এবং বর্ণি ইউনিয়নের কাজিরবন্দ গ্রামের মৃত রমিজ আলীর ছেলে রুবেল আহমদ (২৫)।
বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক বলেন, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ির পাশে সবজি ক্ষেতে কাজ করছিলেন আব্দুল মতিন কুটু। এ সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারান। অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রুবেল আহমদ উপজেলার কাজিরবন্দ এলাকার একটি খালে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। হঠাৎ বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি।
সিলেটের বালাগঞ্জে বজ্রপাতে ইমন আহমদ (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। সে বোয়ালজুড় বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র এবং বালাগঞ্জ ইউনিয়নের চকপীরপুর গ্রামের আনোয়ার মিয়ার ছেলে।
বালাগঞ্জ থানার ওসি গাজী আতাউর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, শনিবার (৬ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে আহত হয় ইমন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জে বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও তিনজন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদেরকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সে ভর্তি করা হয়েছে। শনিবার (৬ জুন) সকালে এ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার সদরের রনিয়া গ্রামের মালিক মিয়ার ছেলে মারফত আলী (১৭), একই গ্রামের আবেদ আলীর ছেলে রবিন মিয়া (১৭) ও শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নূরপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের আছকির মিয়া (৫০)।
পুলিশ জানায়, শনিবার সকালে ৫ কিশোর আজমিরীগঞ্জের হাওরে মাছ ধরতে যায়। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই দুই কিশোর নিহত ও তিনজন আহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
আজমিরীগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন তরফদার জানান, হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে তারা মারা গেছে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় রাখা হয়েছে।
অপরদিকে শায়েস্তাগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাম্মেল হক জানান, সকালে নিহত আছকির মিয়া তার ছেলেকে ডাকতে বাইরে বের হন। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে তিনি আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে চুনারুঘাটে বজ্রপাতে শাহজাহান মিয়া (৪৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি চুনারুঘাট উপজেলার দোহা লালচাঁন এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে।
শনিবার (৬ জুন) বিকেলে হাওড়ে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন তিনি। চুনারুঘাট থানার ওসি শেখ নাজমুল হক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
কমলগঞ্জ : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বজ্রপাতে মো. আব্দুল লতিফ (১২) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। সে কমলগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ গোলেরহাওর গ্রামের ওলিউর রহমানের ছেলে ।
শনিবার (৬ জুন) দুপুর ২ টার দিকে ঝড়-বৃষ্টির সময় দক্ষিণ গোলেরহাওড় গ্রামে জমি থেকে গরু আনতে গেলে বজ্রাঘাতে আহত হয় সে।
পরে স্থানীয়রা তাকে দ্রুত উদ্ধার করে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোস্তফা মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এসব কারণে মেঘের মধ্যে তড়িত প্রবাহিতা বৃদ্ধি পায়। যে কারণে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরাঞ্চলে অত্যধিক বজ্রপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিবাহী অনেক উপাদান যেমন- গাছ, বাড়িঘর এসব থাকে। বজ্রপাতের সময় এসবের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ ছড়িয়ে যাওয়ায় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা কম হয়ে থাকে। তবে হাওর অঞ্চলে খোলা আকাশের নীচে বিদ্যুৎ পরিবাহী কোনো উপাদান থাকে না। ফলে বজ্রপাত সরাসরি মানুষকে আঘাত করে।