মায়ের অপেক্ষার ৮ বছর, এখনও ফেরেনি খোকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২০, ৭:৫৭ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
‘সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে, এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে, খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে,
কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না….।’
সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক সঙ্গীতটি নিজ ভাই আসাদুজ্জামানের স্বরণে লিখেছিলেন গীতিকার রফিকুজ্জামান। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া ছোট ভাইয়ের ফিরে আসার জন্য মা বাড়ির পাশের রেললাইনে অপেক্ষা করতেন, কখন ফিরবেন খোকা, কিন্ত আর ফেরেনি খোকা (আসাদ)।
মৃত্যুর মাধ্যমে আসাদের মায়ের অপেক্ষা শেষ হয়েছে, কিন্তু অপেক্ষা শেষ হয়নি নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর মা সূর্যবান বিবির। খোকার (ইলিয়াস) পথ চেয়ে আছেন এখনও, সেই অপেক্ষার দীর্ঘ ৮ বছর পূর্ণ হলো। এই আট বছরে পরিবার থেকে শুরু করে নেতাকর্মীরা হাল ছাড়েননি। ইলিয়াস আলীর ফেরার আশায় আছেন সবাই।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক, সাবেক ছাত্রনেতা, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক জেলা সভাপতি ও সাবেক সাংসদ এম ইলিয়াস আলী ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আট বছর বছর পূর্ণ হলো শুক্রবার, এপ্রিল ১৭, ২০২০।
এপ্রিল ১৭, ২০২০, কালরাতে ঢাকার বনানী থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন ইলিয়াস। ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময় ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে জোরালো আন্দোলন দানা বাধে ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে। জাতীয় রাজনীতিতেও রাখছিলেন বলিষ্ঠ ভূমিকা।
৭৭ বছর বয়সী মা সূর্যবান বিবি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরারে কেউ লোকাইয়া রাখছে। এক কালবৈশাখ নিছে, আরও এক বৈশাখে আইব!’
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদী। তাদের দুই পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তাদের বড় ছেলে মো. আবরার ইলিয়াস পশ্চিম ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন এবং ছোট ছেলে মো. লাবিব শারর কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। সর্ব কনিষ্ঠ সায়ারা নাওয়াল বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যয়ন করছে। তারা অপেক্ষায় আছেন ইলিয়াস ফিরবেন।
ইলিয়াস আলীর সঙ্গে নিখোঁজ গাড়িচালক আনসার আলীর পরিবারেও একই রকম ফেরার আশা। বিশ্বনাথের গমরাগুল গ্রামে আনসারের বাড়িতে আছেন মা, স্ত্রী ও নয় বছর বয়সী আনসারের এক কন্যাসন্তান।
আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম দৃঢ়তার সঙ্গে গত বছর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘যেখানেই আছেন স্বামী (আনসার আলী), সঙ্গে নিশ্চয় তিনিও (ইলিয়াস আলী) আছেন। তারা জীবিত আছেন, একদিন ঠিকই ফিরবেন।’
ইলিয়াস আলী কোথায়, তিনি কি ফিরবেন, না ফিরবেন না — এই দ্বিধা কাটেনি এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। তার মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন, পরিবার এক অসহনীয় ব্যথা নিয়েই পার করছেন প্রতিটি ক্ষণ।
তিনি ১৯৮০ সালে বিএনপির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, যা এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীম উদ্দিন হলের মধ্যে বসবাস করেছেন। কয়েক বছরের মধ্যে, তিনি হলের নেতা হন এবং ১৯৮৩ সালে জাতীয়তাবাদি ছাত্রদলের (জেসিডি) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য হন। ১৯৮৬ সালে, জেসিডির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সচিব হিসাবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরশাদ কিছু রাজনৈতিক অধিকার পুনরুদ্ধারের স্বীকৃতি দিলেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করে এবং উভয় দলের ছাত্ররা এই দাবি নিয়ে প্রতিবাদ করতে আগ্রহী ছিল। এরশাদ ১৯৮৭ সালে, ইলিয়াস আলীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিসিডির ৯ ছাত্র নেতাকে বহিষ্কারের আদেশ দেন। ১৯৮৮ সালে তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্রেফতার হন। সাত মাস কারাগারে থাকার পর, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আদেশে ইলিয়াস আলী কারাগার থেকে মুক্তি পান।
তত্ত্ববধায়ক সরকারের দাবিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির আন্দোলন চলছিল। সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ২০১০ সালে নির্বাচিত হয়ে তিনি হরতাল (সাধারণ ধর্মঘট) থেকে শুরু করে প্রতিরোধ কর্মসূচি, বিক্ষোভ এবং দলগঠন সহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সমন্বয় সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় মধ্যরাতে তাকে এবং তার গাড়ি চালককে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, অভিযোগ আনেন যে বিরোধীদের দমন নিপীড়নের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের অপহরণ করে, কিন্তু সরকার সে দাবি অস্বীকার করেছে।