বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া কতটা জড়িত?
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০১৬, ১২:৩৭ অপরাহ্ণ
পীর হাবিবুর রহমান:
বঙ্গবন্ধু হত্যায় সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে বেনিফিসিয়ারি হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন কি না এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, রহস্যও রয়েছে। কোন গবেষণার মাধ্যমে তার ফায়সালা হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা মঞ্চের বক্তৃাতায় মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়ার বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ নিয়ে হাজির হননি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আনন্দবাজার পত্রিকার ঢাকা ব্যুরো প্রধান সুখরঞ্জণ দাশ গুপ্ত সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে গ্রন্থ লিখেছিলেন ৭৮ সালে; সেখানে বলেছিলেন, শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ তাকে বলেছেন, সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এক সন্ধ্যায় তার বাসভবনে গিয়েছিলেন। তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মুজিব সরকারকে সরিয়ে মার্শাল ল জারির প্রস্তাব দিলে তাজউদ্দিন রাজি হননি। সে রাতেই তাজউদ্দিন দৌঁড়ে গিয়েছিলেন ৩২ নম্বরে।
বঙ্গবন্ধুকে সবকিছু অবহিত করলেও আমলে নেননি। মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘বিএনপি সময়-অসময়’ গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাক ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেন। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ব্রি. মাশহুরুল হক, ব্রি. সি আর দত্ত এবং ব্রি. কাজী গোলাম দস্তগীর- এ তিনজন জ্যোষ্ঠ সেনাকর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে দিল্লিতে একটা সামরিক কোর্সে থাকাবস্থায় ব্রি. এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদন্নোতি দিয়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে একই দিন জেনারেল অব. ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বানানো হয়।
জিয়া ছিলেন ফারুক-রশীদের পছন্দের লোক। সেনাপ্রধান হওয়ার খবরটা পেয়ে জিয়া শুধু খশিই হননি, তিনি মাত্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্ণেল এম এ হামিদের বর্ননায় ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টায় জেনারেল জিয়া তাকে টেলিফোন করেন। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কাম হিয়ার জাস্ট নাও।’ কর্ণেল হামিদ অফিসে একটা কনফারেন্সে ছিলেন। জানতে চাইলেন, একটু পরে আসলে হবে কি না। জবাবে জিয়া বললেন, সার্ট আপ কাম জাস্ট নাও। মিটিং শেষ করেই হামিদ জিয়ার কাছে ছুটলেন। তারা দুজন কোর্স মেট অফিসের বাইরে তুই-তোকারি সম্পর্ক। জেনারেল জিয়ার অফিস কক্ষে ঢুকতেই সামরিক কায়দায় ডাক মেরে গর্জে উঠলেন তিনি। হামিদকে বললেন, স্যালুট প্রোপারলি ইউ গো পি ইউ আর এন্টারিং চিফ অব স্টাফস অফিস। হামিদ থমকে গেলেন, জেনারেল জিয়া হাতে টাইপ করা কাগজ হামিদকে দিয়ে মুচকি হাসতে লাগলেন। হামিদ পড়ে দেখলেন জেনালের জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগদানের অফিসিয়াল চিঠি।
জেনারেল জিয়া হামিদকে প্রশ্ন করলেন, এখন কি করা যায়? হামিদের পাল্টা প্রশ্ন, শফিউল্লাহ চিঠি পেয়েছে? জিয়া বললেন না এখনো কেউ জানে না। কর্ণেল হামিদ বললেন, তাহলে তো তার কাছেও কপি পৌঁছাতে হবে। তারপর অফিসিয়ালি সে হয়তো কয়েকদিন সময় নিয়ে তোমাকে ‘হ্যান্ড ওভার’ করবে। এখন একটু চুপ থাকবে। জিয়া বললেন সার্ট আপ, আমি কাল থেকেই টেক ওভার করব। আমি তাকে বোঝালাম, তুমি তো ‘ক্যু’ করতে যাচ্ছ না। সরকারের অফিসিয়াল চিঠি রয়েছে। তোমাকে তো এফয়েন্টমেন্ট দেওয়াই হয়ে গেছে। জিয়া বললেন, তুই এসব বুঝবি না, হি ইজ ভেরি ক্লেভার পারসন। তুমি আগামীকাল ঢাকা স্টেশনের সব ইউনিটে অফিসার ও সৈনিকদের বড় মাঠে একত্র হওয়ার নির্দেশ পাঠাও।
পরদিন সকালে সারা ক্যান্টনমেন্টে মহা উত্তেজনা। অফিসার, যোওয়ান সবাই সিগন্যাল ম্যাসের গ্রাউন্ডে সমবেত হয়েছে। কেউ কিছু জানে না। কি ব্যাপার! ঠিক সাড়ে ৭টায় জেনারেল জিয়া মঞ্চে এসে হাজির। সবাই এটেনশন। জিয়া মঞ্চ থেকে চিৎকার করে গর্জন করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন, আজ থেকে আমিই সেনাপ্রধান, বলেই মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। এসব বিষয়ে অন্ধকারে থাকা জেনারেল শফিউল্লাহ হামিদকে প্রশ্ন করলেন, এসব কি হচ্ছে? বিরক্ত ও অপমানবোধ করলেও পরিস্থিতির কারণে পরিবর্তন মেনে নিতে বাধ্য হলেন। সেদিন থেকেই শফিউল্লাহ আর অফিসে আসলেন না।
লেখক মহিউদ্দিনের ভাষায় শেখ মুজিব নিহত না হলে, জিযার উত্থান হত না। কিন্তু এটাও ঠিক সাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে শফিউল্লাহ নন, জিয়াই হতেন সেনাপ্রধান। জিয়া সেনাবহিনী ছেড়ে অন্য কোন বেসামরিক পদে চাকরির ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। বলা যায়, তিনি মাটি কামড়েই পড়েছিলেন। একজন পেশাদার সেনাকর্মকর্তা হিসেবে তিনি তার বাহিনীর চূড়ায় আরোহনের স্বপ্ন দেখতেই পারেন। একটা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিজের আখের ঘুচিয়ে নেয়ার ভুরি ভুরি উদাহারণ আছে। জিয়াউর রহমান এ ধরনের কোন পরিকল্পনা করেছিলেন কি না, এটা নিয়ে কোন একাডেমিক গবেষণা বা বিশ্লেষণ হয়নি।
জিয়ার দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দেয়ার পক্ষে একটিমাত্র উদাহরণ উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর তা হল- তার সঙ্গে দেখা করে রশীদের কথাবার্তা বলার ঘটনাটি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের এ অপরাধের কথা তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অথাৎ সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে জানাননি। -সন্দেহের উৎস এখানেই। তবে দুটো ঘটনার উল্লেখ করা চলে, তাতে মনে হতে পারে জিয়া নিজে সরাসরি কোন ষড়যন্ত্র করেননি, ষড়যন্ত্রের সুবিধাভোগ করেছেন। ১৫ আগস্ট সকাল ৬টায় রশীদ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ৪৬ ব্রি. কমান্ডার কর্ণেল শাফায়াত জামিলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন, ‘উই হ্যাভ কিলড শেখ মুজিব’। শাফায়াত তার ব্রি. মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমেই গেলেন উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। শাফায়াতের কাছে সব শুনে জিয়া হকচকিত হয়ে গেলেন। তবে তিন বিচলিত হলেন না।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইয়োর ট্রুপস রেডি আপস হোল্ট দ্যা কনস্টিটিউশন।’ অক্টোবরের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর প্রমোশনের বোর্ডের সভায় লে. কর্ণেল হিসেবে পদন্নোতির জন্য কয়েকজন মেজরের নাম প্রস্তাব করা হয়। রশীদ, ফারুক ও ডালিমের নাম ছিল এ তালিকায়। কর্ণেল শাফায়ত জামিলের ভাষ্যনুযায়ী, তিনি প্রমোশনের পরিবর্তে তাদের বিচারের জন্য সুপারশ করেন। বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল কাজী গোলাম দস্তগীর, ব্রি. সি আর দত্ত এবং কুমিল্লা ব্রি. কমান্ডার কর্ণেল আমজাদ আহমদ চৌধুরী শাফায়াতকে সমর্থন দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তাদের বিরোধীতা খড়কুটোর মত ভেসে যায়। রশীদ, ডালিম ও ফারুক পদন্নোতি পান।
এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর মোশতাক আহমদ ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ আগস্ট অভ্যূত্থান ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের আইনী সুরক্ষা দেন। এই আদেশে আরো বলা হয়েছিল, ১৫ আগস্ট অভ্যূত্থানের সঙ্গে জড়িত কারো বিচার করা যাবে না। কর্ণেল হামিদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। সেখানে আগস্ট হত্যাকাণ্ড উত্তর ক্ষমতার লড়াইয়ের নানাদিক স্পষ্টে হয়ে উঠেছে। খুনি মেজরদের উৎখাত আর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে এবার এক ফ্ল্যাট ফর্মে এসে দাঁড়িয়েছেন শাফায়াত জামিল ও খালেদ মোশাররফ। তারা জিয়াকে শক্ত অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কিন্তু জিয়া নিরুত্তর। তিনি একূল-ঐকূল দুকূল রক্ষা করে চলছিলেন। জিয়া দুপ্রান্তের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন।
একদিকে ফারুক-রশীদের পিঠ চাপড়ানো, শাফায়াত জামিলের কাঁধে হাত দু-ই করছিলেন। তলে তলে আরেকটি কাজ করছিলেন। তা হল- তিনি সবার অজ্ঞাতে জাসদের অব. কর্ণেল আবু তাহেরের সঙ্গে গোপন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জাসদের আর্মস উইং আন্ডারগ্রাউন্ড কাজকর্মে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। শেখ সাহেবকে উৎখাতের জন্য ইতিপূর্বে তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জিয়া সবার অজ্ঞাতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার সুহৃদ কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে গোপন কথাবার্তা চালিয়ে যান। খুনি ফারুক-রশীদচক্র অসংখ্যবার স্বাক্ষাতকালে যেমন বলেছে ৭৫-এর পট পরিবর্তনের কথা তারা সেনাবাহিনীর চিফ অব ডেপুটি জেনারেল জিয়াকে অবহিত করেছিল। তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এটা শুধু অভিযোগের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখেননি। আওয়ামী নেতকর্মীরা এটা বিশ্বাসও করেন। আওয়ামী নেতাকর্মীদের কাছে এটা গভীর বেদনারও। তেমনি জিয়া পরিবার বা বিএনপি নেতৃত্ব বিশ্বাস করে। এটি তাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের ওপর আক্রোশ ও মিথ্যাচারের বহি:প্রকাশ। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির বিভক্তিতে দগদগে ক্ষত চিহ্ন হয়ে এটি কাজ করছে।
পীর হাবিবুর রহমান, প্রধান সম্পাদক: পূর্বপশ্চিম