বিক্ষুব্ধ শাহবাগ অচল ক্যাম্পাস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০২৪, ৩:৩৭ অপরাহ্ণ
দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শাহবাগ মোড়ে টানা ৬ ঘণ্টা অবরোধ। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। কিছুই থামাতে পারেনি বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের। মুহুর্মুহু স্ল্লোগানে মুখর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। উত্তাল শাহবাগ থেকে একটাই বার্তা- কোটা নামক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যাবে না মেধাকে। বাতিল করতে হবে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি। যতক্ষণ না কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহাল হচ্ছে ততক্ষণ চলবে আন্দোলন। তারুণ্যের এ বিক্ষোভ শুরুতে থামাতে চেয়েও পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দিনের শেষে আন্দোলনকারীরা কোটা বাতিলের দাবিতে দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এর মধ্যে রয়েছে শনিবার সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি। আর রোববার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ অবস্থান ধর্মঘট। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উত্তাল ছিল দেশের সব ক্যাম্পাস। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে একটাই স্লোগান দেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নেই।’ অন্যদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়েছে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আলোচনা বা সরকারের তরফে কোনো আশ্বাস না মেলায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারী নেতৃবৃন্দ।
ওদিকে গতকাল ছিল কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর আপিল বিভাগের শুনানি। তার একদিন আগেই শিক্ষার্থীরা জানিয়ে রাখেন হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা হবে। সকালে আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেননি। এ খবর সামনে আসতে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জড়ো হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে। সেখান কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্ল্লোগান দিতে থাকেন তারা। বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা যখন বৃহত্তর কর্মসূচি পালনের উদ্দেশ্যে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে আসতে থাকেন তখন হল গেটে বসে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের পাহারা। মাস্টারদা’ সূর্যসেন হল, কবি জসীমউদ্্দীন হল, বিজয় একাত্তর হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, স্যার এফ রহমান হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দেয়া হয়। তালা দেয়া হয় জসীমউদ্্দীন হল ও সূর্যসেন হল গেটে। মেহেদী হাসান নামে সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, ছাত্রলীগের বন্ধু এবং ভাইয়েরা আজ আমাদের আটকে দিলেন। ওরা ক্যান্ডিডেট ৬-৭ জন গেট আটকালো। কিন্তু আমরা ১৫০-২০০ জন ছিলাম, তাও সাহস করে কেউ লাথি মেরে বের হতে পারলাম না। সবার মনে ভয় উদ্যোগটা নেবে কে? আমি নেবো? আমার পরিণতি কী হবে? কারণ হল থেকে বের করে দিলে যে থাকার জায়গা নেই। জুনিয়রগুলোকে এক ধমক দেয়াতে দেখি সঙ্গে সঙ্গে শতাধিক জুনিয়র এদিক-সেদিক চলে গেল। যারা বাধা দিয়েছেন তারা তো গোলামির জীবন আগেই বেছে নিলেন, আমাদের কেন গোলাম হতে বাধ্য করছেন। এ খবর চাউর হতেই সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে কোটাবিরোধী বিশাল মিছিল গিয়ে সূর্যসেন হলে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিয়ে আসেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের খবর পেয়ে সটকে পড়েন ছাত্রলীগ নেতারা। এরপর অন্য হলগুলো থেকেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকে ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিশাল মিছিল ভিসি চত্বর ও টিএসসি হয়ে শাহবাগ পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের অবরোধ ঠেকাতে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু তারুণ্যের স্রোতে রাস্তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। দুপুর ১২টার পর শাহবাগ মোড়ে বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’- স্লোগান দেন। বিকালে অবরোধ কর্মসূচি তুলে নিয়ে দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে রয়েছে শনিবার বিকাল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি ও রোববার সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ অবস্থান ধর্মঘট পালন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ঘোষিত চার দফা দাবির ভিত্তিতে আগামী শুক্রবার অনলাইন ও অফলাইনে আমাদের জনসংযোগ কর্মসূচি চলবে। যেটি কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের নির্বাহী বিভাগ বা উচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের কোনোরকম আশ্বস্ত করা হয়নি, এমনকি কোনো ধরনের যোগাযোগও করা হয়নি। আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার কী পরিপত্র জারি করলো যে, যেটি পাঁচ বছরের মধ্যে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে হাইকোর্ট? তার মানে পরিপত্র জারি যথাযথ নিয়ম মেনে হয়নি। এখনো সময় আছে পুনরায় পরিপত্র জারি করার। আইন বিভাগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করে দেয়ার এই নাটক আর মঞ্চস্ত করতে দেয়া হবে না। শিক্ষার্থীরা যখন শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন তখন বৃষ্টিও হানা দেয়। কিন্তু বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যান। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে শাহবাগ এলাকায় বন্ধ থাকে যান চলাচল। তারা বলেন, এ বৃষ্টি আমাদের আন্দোলনে প্রেরণা হয়ে এসেছে। আমাদের আন্দোলন কোটা প্রথার বিলুপ্তি পর্যন্ত চলবে। কোনোভাবেই আমরা এ বৈষম্য মেনে নেবো না। কোটা নামক শৃঙ্খল থেকে তারুণ্য বের হয়ে আসবে। এ আন্দোলনের বিজয় অপরিহার্য। আন্দোলনে অংশ নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সালমান বলেন, আমরা দাবি আদায়ের আগ পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বো না। সারা দেশের ছাত্রসমাজ আজ জেগে উঠেছে। আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, আজ বৈষম্যের কোটার বিরুদ্ধে শুধু শাহবাগ নয়, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেছেন। জাবি শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, চবি শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম, কুবি শিক্ষার্থীরা কুমিল্লা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশালে অবরোধ করাসহ সারা দেশই মূলত অকার্যকর হয়ে আছে। আমরা কোটা পুনর্বহালের আদেশ মানি না। শিক্ষার্থীরা এই বৈষম্য মেনে নেবেন না। চার দফা দাবিকে সামনে রেখে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হলো- ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠনপূর্বক দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরির সমস্ত গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেয়া (সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী ব্যতীত); সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া; দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের: একই দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ৩০ মিনিট অবরোধ করে রাখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে অবরোধ করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম ইমন বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখা হয়েছে। কোটা বৈষম্য বহাল রেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন করার কারণে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করতে বাধ্য হয়েছি আমরা।
বাকৃবি শিক্ষার্থীদের রেললাইন অবরোধ: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অভ্যন্তরীণ রেললাইনে চলমান ট্রেন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ট্রেনের যাত্রীরা। তবে দুই ঘণ্টা অবরোধের পর বিকাল সোয়া তিনটার দিকে ট্রেনটি ছেড়ে দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এর আগে বেলা ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি কে. আর. মার্কেট হয়ে মুক্তমঞ্চের সামনে দিয়ে এসে আব্দুল জব্বার মোড়ে অবস্থান নেয়। দুপর ১টা ১০ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জামালপুরগামী জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসতেই অবরোধের কবলে পড়ে। প্রায় ২ ঘণ্টা অবরোধের পর দুপুর ৩টা ১০মিনিটে অবরুদ্ধ ট্রেনটি ছেড়ে দেয়া হয়। এসময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী প্রণব ঘোষ বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলন চলছে এবং কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আন্দোলন আরও কঠোর হবে।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে। এর আগে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন সংলগ্ন প্যারিস রোডে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। অবরোধ কর্মসূচিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুশফিক মঈন বলেন, কোটার মতো একটি চরম বৈষম্য আমাদের ওপর পুনরায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বৈষম্য আমাদের পূর্বপুরুষরাও মানেননি, আমরাও মানবো না।
চবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ: হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় বিক্ষোভ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেট এলাকার চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক অবরোধ করে তারা। এতে ওই এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী জানে আলম বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয় নিজেদের সন্তান আর নাতি-নাতনির কোটার জন্য লড়াই করেননি। তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাহলে আজ কেন এই বৈষম্য। আমরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বো না। জীবন দেবো তবুও দাবি আদায় করে ছাড়বো।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ কুবি শিক্ষার্থীদের: সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে তিন ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা। পরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে তারা। তবে দাবি মানা না হলে রেললাইন অবরোধ করারও হুঁশিয়ারি দেন তারা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মহাসড়কে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’র ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়। শিক্ষার্থীদের অবস্থানের ফলে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
ইবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ: মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর ১২টায় ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এর আগে সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, ২০১৮ সালে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল, সম্প্রতি হাইকোর্ট সেটা পুনর্বহাল করে রায় দিয়েছে। আমরা এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করছি। চাকরি পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষাসহ সবখানে কোটার ছড়াছড়ি। এর মাধ্যমে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
শাবিতে বিক্ষোভ: বিক্ষোভ করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর থেকে কোটাবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এসে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। আন্দোলনকারী রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন, শিক্ষার্থীরা কোটার পক্ষে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্রের পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে।
মহাসড়ক অবরোধ ও প্রতীকী বই পুড়িয়ে বিক্ষোভ ববি শিক্ষার্থীদের: একই দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, প্রতীকী বই পুড়িয়ে বিক্ষোভ করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করে তারা। এসময় সড়কে বই ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৩টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটা রেখে বাকিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যারা বাংলাদেশের মেধাবী রয়েছে, তাদের যোগ্যতা কেন কেড়ে নিচ্ছে? এ সিদ্ধান্ত দেশকে মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত করবে।
শেকৃবি শিক্ষার্থীদের আগারগাঁও মোড় অবরোধ: আগারগাঁও মোড় অবরোধ করেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটক সংলগ্ন আগারগাঁও মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে মিরপুর-ফার্মগেট এবং মহাখালী-শিশুমেলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে এবং দুই রুটে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। দুপুর দেড়টায় অবরোধ তুলে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে।
আন্দোলনে অনড় শিক্ষকরা, আলোচনা হয়নি মন্ত্রীদের সঙ্গে
টানা চতুর্থদিনের মতো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের অন্তত ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’কে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে নিজেদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা। গতকাল আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়।
প্রতিদিনের মতো গতকাল দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের নিচতলায় জড়ো হন শিক্ষকরা। এ সময় ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আজকের বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি জরুরি সাক্ষাৎ রয়েছে। তাই তিনি আমাদের সময় দিতে পারেননি। শুক্রবার মন্ত্রী বৈঠকের বিষয়ে আমাদের জানাবেন।
এ সময় তিনি, সর্বজনীন পেনশন প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে আন্দোলন ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা দুটোই চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান।
উল্লেখ্য, সর্বজনীন পেনশন স্কিম সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন’ প্রত্যাহার এবং পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখার দাবিতে গত ২০শে মে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তারই ধারাবাহিকতায় ২৬শে মে বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এরপর ২৮শে মে দুই ঘণ্টা এবং ২৫-২৭শে জুন তিনদিন সারা দেশে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়। পরবর্তীতে ৩০শে জুন পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করা হয় এবং ১লা জুলাই থেকে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়।
আন্দোলনরতদের তিনটি দাবি- ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে টানা চতুর্থদিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ। ফলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ে ও কর্মচারী সমিতি প্রশাসনিক ভবনের সামনে কর্মবিরতি পালন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
কর্মসূচিতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবির প্রেক্ষিতে আমাদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। শুক্রবার ও শনিবারের মধ্য আমাদের জন্য পজেটিভ কোনো সিদ্ধান্ত না আসলে আমাদের আন্দোলন আরও তীব্র হবে। কর্মচারী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছরওয়ার হোসেন খোকন বলেন, সরকার কর্তৃক যে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে তা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্বিষহ। যে টাকা দিয়ে আমাদের বেতন হয় তা দিয়ে আমাদের দিনাতিপাত করতে কষ্ট হয়। সরকারের এই হটকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যয় স্কিম নামক সর্বজনীন পেনশন আমাদের জন্য ক্ষতিকর। আমরা সরকারে কাছে এই পেনশন প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’কে বৈষম্যমূলক দাবি করে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তারা প্রচলিত সরকারি পেনশনে থাকার দাবিতে গত সোমবার থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন। এই কর্মবিরতির কারণে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ সব ধরনের একাডেমিক কাজ অচল হয়ে পড়েছে।
গতকাল কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সামনে অনুষ্ঠিত কর্মবিরতি পালন অনুষ্ঠানে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. মুহাম্মদ আল মামুনের সঞ্চালনায় এবং সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ছফি উল্লাহ ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার পরিষদ ও কর্মচারী পরিষদও কর্মবিরতি ও প্রতিবাদ সভা পালন করেন।
এ সময় বক্তারা বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যারা প্রত্যয় স্কিম তৈরি করলেন তারা কেন এর বাইরে থাকলেন। তাদের জন্য কেন সেবক স্কিম। স্বাধীন দেশে সকল সরকারি কর্মচারীদের একই পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বক্তারা বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম বাতিলের দাবি জানান। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পেনশন সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন’ প্রত্যাহারের দাবিতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) এর শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল চতুর্থদিনের মতো সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরবর্তীতে সেমিনার রুমে মতবিনিময় এবং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে শিক্ষকগণ বক্তৃতা প্রদান করেন। এতে অচলাবস্থায় পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা। এমতাবস্থায় শিক্ষকরা সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষককে অবমূল্যায়ন করে কোনো জাতি কখনো বড় হতে পারেনি, পারবে না। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান ও সুযোগ দেয়ার বিকল্প নেই। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উভয়ের কথা বিবেচনা করে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অচল অবস্থায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিও। গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি ও দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা একাডেমিক ভবনের নিচে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন হাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। এ ছাড়াও বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশন’র ব্যানারে ড. এম ওয়াজেদ ভবনের নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
হাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. সাদেকুর রহমান বলেন, বিগত ১৫ বছরে একদিনের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। কিন্তু আজকে একটি জটিল ইস্যু তৈরি হয়েছে যেটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আত্মমর্যাদার ইস্যু। আমরা প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার চাই না, কিন্তু প্রত্যয় স্কিম থেকে আমাদের প্রত্যাহার করা হোক। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম থেকে প্রত্যাহার করে তাদেরকে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল কাঠামোতে আনা হোক। আর এই আন্দোলন আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলবে।