সিলেটের ৮৩৫ গ্রামের ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৪, ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরুঃ
সিলেটে দিন দিন পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রশাসনের তথ্য মতে; জেলার ৮৩৫টি গ্রামের ৭ লাখের অধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। প্লাবিত হয়েছে ১১টি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। সুরমা অববাহিকতায় পানি কিছুটা কম বাড়লেও কুশিয়ারা অববাহিকায় পানি হু-হু করে বাড়ছে। জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজারের সঙ্গে গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরে নতুন করে পানি ঢুকেছে। বৃষ্টি হলেই সিলেট নগরে পানি বাড়ে। নগরের অর্ধশতাধিক এলাকা পানি নিচে রয়েছে। এই অবস্থায় ছুটি সংক্ষিপ্ত করে আজ-কালের মধ্যে লন্ডন থেকে সিলেট আসছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। নগর ভবন সূত্র জানিয়েছে; বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় নগরে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ হাজার মানুষ উঠেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- সিলেটের চারটি পয়েন্টে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। এরমধ্যে রয়েছে কানাইঘাটে সুরমা, জকিগঞ্জে অমলসীদ, বিয়ানীবাজারে শ্যাওলা ও ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা। ভারতের বরাক নদী দিয়ে সিলেটের প্রবেশমুখ অমলসীদ হয়ে পানি আসছে। আর শতকরা ৭০ শতাংশ পানি টানছে কুশিয়ারা নদী। এ কারণে কুশিয়ারা অববাহিকার তিনটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানিয়েছেন- বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটের নদ-নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেটে দু’টি নদীর চারটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এখন গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ এলাকা দিয়ে পানি প্রবেশ করছে বলে জানান তিনি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- গোলাপগঞ্জের ৫টি ইউনিয়নে, বালাগঞ্জের চারটি, ওসমানীনগরের তিনটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এক সপ্তাহে উজানের ঢলের প্রথম ধাক্কায় পানি ঢুকেছিল হাওর ও খাল বিলে। এখন পানি বাড়ায় রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বহু স্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে দিকে ছুটছে মানুষ। জকিগঞ্জের নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষজন পানিবন্দি রয়েছে। তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। বিয়ানীবাজারের ৬টি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ওসমানীনগরের সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, উসমানপুরসহ কয়েকটি এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবু আহমদ সিদ্দিকী জানিয়েছেন- ফ্লাস ফ্লাডে সিলেট প্লাবিত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের উদ্ধার, আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার দেয়া হচ্ছে। এই ফ্লাড থেকে বাঁচতে নদী এলাকার বালু ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে; সিলেট জেলায় ৫৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ইতিমধ্যে ৬ হাজার ৫৬৮ জন বানবাসী মানুষ উঠেছেন। সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া নগরের ২৮টি ওয়ার্ডে পানি ঢুকেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস মতে; সিলেট জেলায় আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৭ ঘণ্টায় সিলেটে ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেট নগরের উপশহর এলাকা এখনো পানির নিচে। তার সঙ্গে প্লাবিত হয়েছে কুশিঘাট, মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, কালিঘাট, কাজিরবাজার, শামীমবাবাদ, ঘাষিটুলা, বেতের বাজারসহ কয়েকটি এলাকা। সুরমার পানি উপচে এসব এলাকায় পানি ঢুকেছে। উপশহরের প্রধান সড়ক থেকে সোমবার রাতে পানি নেমেছে। তবে এখনো এ, বি, সি, ডি ও ই ব্লকের ভেতরে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি রয়েছে। হাজারো বাসার নিচতলায় পানি উঠে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে নিরাপদে চলে গেছেন এসব বাসার বাসিন্দারা।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম আহমদ জানিয়েছেন- উপশহরে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন তাদের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া যারা বাসাবাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তাদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল শুকুর আফসোস করে বলেন- নগরের উপশহর হচ্ছে অভিজাত এলাকা। এখানকার বাসার মালিকরা হচ্ছেন প্রবাসী। অথচ গত ৫-৬ বছর ধরে সুরমা উপচালেই উপশহর পানির নিচে তলিয়ে যায়। বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য বার বার দাবি জানানো হলেও নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কবে এই উদ্যোগ নেয়া হবে সেটিও তারা কাউকে বলেন না।
নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন- সুরমার পানি উপচে প্রথমেই কাজিরবাজারের গরুর হাট পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর সেই পানি ছড়া দিয়ে এসে তালতলায় প্রবেশ করে। এ এলাকার পানি একটু কমলে বৃষ্টির পানিতে আবার বেড়ে যায়। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন হাজারো মানুষ। সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর মানবজমিনকে জানিয়েছেন; বন্যার পানিতে সিলেট নগরের অর্ধেক এলাকা প্লাবিত হওয়ায় লন্ডনে অবস্থান করা মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সফর সংক্ষিপ্ত করে সিলেট ফিরছেন। তিনি সিলেটে ফিরে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। এখন আমরা তার নির্দেশে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার কার্যক্রম চালাচ্ছি। তিনি জানান- সিলেট নগরে আশ্রয়কেন্দ্র ছিল ১৯টি। পানি কমে যাওয়ায় নগরের মধ্য এলাকার মানুষ বাড়ি ফিরছে। রাতে ও দুপুরে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষদের রান্না করা খাবার দেয়া হয়েছে। বৃষ্টি না হলে উপশহরসহ কয়েকটি এলাকার পানি দ্রুত নেমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ওদিকে, সিলেটে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন নগরের সাবেক মেয়র ও বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী। সোমবার সকাল থেকে তিনি নগরীর উপশহর, সুবহানীঘাটসহ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেন। এসব এলাকায় তিনি বন্যার্ত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেন। গতকালও তিনি নগরের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় আরিফুল হক চৌধুরী নগরবাসীকে ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে বলেন- বড় প্রকল্প ছাড়া নগরের এই দুর্দশা কাটানো সম্ভব নয়। নদী খনন করা ছাড়াও সুরমার তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে নগর রক্ষা করা সম্ভব হবে। সুত্র-মানবজমিন