পণ্যের অগ্নিমূল্যে দিশাহারা মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৬:৪৭ অপরাহ্ণ
আনিস মিয়া। সোমবার রাজধানীর রায়ের বাজারে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা হিসাব মিলাচ্ছিলেন। পকেট থেকে টাকা হাতে নিয়ে বার বার গুনছেন। আর নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘ভাই এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে এসেছিলাম। শুধু একটা মাছ নিয়েছি। হাতে এখন ৩১০ টাকা আছে। এখনো সবজি কিনি নাই। চাল-তেলও কিনতে হবে। কী করবো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারছি না।’ এর পাশেই সবজি বাজারে একজন দোকানির সঙ্গে বাকবিতণ্ডা লক্ষ্য করা গেল। কাছে গিয়ে জানা যায়, দর কষাকষি নিয়ে তাদের এই বচসা। ঝগড়া হচ্ছিলো ইয়াকুব আলী নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে আমরা জিম্মি। যে যেমন খুশি দাম হাঁকাচ্ছে। এক কেজি বেগুন ১৪০ টাকা। শিম ২০০ টাকা কেজি। গাজর ১৫০ টাকা। টমেটো ১৪০ টাকা। বরবটি ১০০ টাকা। ঢেঁড়শ ৮০ টাকা। করলা ৮০ টাকা। কচুরমুখী ১০০ টাকা। পটোল ৬০ টাকা। পেঁপে ৫০ টাকা। ছোট্ট একটা ফুলকপি ৬০ টাকা। বাঁধাকপি ৫০ টাকা। সবজি কেনা তো বাদই দিলাম। শাক-পাতা খেয়ে বাঁচবো তাও ২০ থেকে ৩০ টাকার নিচে আঁটি নেই। আমরা কোথায় যাবো! কী করবো! কে আমাদের এই অসহায়ত্ত থেকে মুক্তি দেবে। দোকানি বলেন, ‘আমাদের তো এখানে কিছু করার নেই। আমরা পাইকারি আড়ৎ থেকে যেই দামে পণ্য ক্রয় করি, তার সঙ্গে আনা-নেয়া খরচ ও নিজের কিছু লাভ যোগ করে বিক্রি করি। আমাদেরও তো পরিবার আছে। তাদেরও পেট আছে।’
এদিকে মাছ বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই মাছের দাম শুনে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এমনই একজন বোরহান মিয়া। পেশায় একজন রিকশাচালক। তিনি বলেন, আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে। ও বড় মাছ খুব পছন্দ করে। সপ্তাহ দুয়েক তেমন কোনো মাছ কিনি নাই। আজকে বাচ্চাটা খুব বায়না ধরেছে। তাই বাজারে এসেছিলাম একটা ছোটখাটো মাছ কিনতে। কিন্তু মাছের দাম অনেক। মাঝারি সাইজের রুই মাছগুলো সাড়ে ৪০০ টাকা কেজি চাইছে। কাতল মাছও একই। ইলিশ মাছ যে কতোদিন খাই না, সেটা মনে নেই। ভেবেছিলাম সিজনে একটু দাম কমবে। এখন দেখি তাও ১৫শ’-১৬শ’ টাকার নিচে নেই। তাই ভাবছি আজকে আর মাছ কিনবো না। এক হালি ডিম নিয়ে যাই। ওটাই সবাই মিলে ভাগ করে খাবো। এদিকে ফল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানিরা অনেকে অলস সময় পার করছেন। এমনই এক ফলের দোকানি বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার নিয়েই দিশাহারা সাধারণ মানুষ। এখন আর আগের মতো মানুষ ফল বাজারে আসে না। যারা আসেন তারও সংখ্যা কম। যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকু কিনতেই আসে।
অপর দিকে পলাশী বাজারে গিয়ে দেখ গেছে, সেখানেও কোনো পণ্যের কমতি নেই। প্রতিটি দোকানেই থরে থরে সাজানো রয়েছে আলু, পিয়াজ, কাঁচা মরিচ, গাজর, বরবটি, শিম, বাঁধাকপি, ফুলকপি সহ বিভিন্ন রকমের শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই ছোট করছেন বাজার লিস্ট। কেউ আবার ১ কেজির বদলে নিচ্ছেন এক পোয়া। এমনই একজন বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থায় এক নৈরাজ্য চলছে। কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মনিটরিং নেই। গতকাল যে দামে পণ্য কিনি, পরের দিন বাজারে এসে দেখি নতুন দাম। প্রতিদিনই দাম বাড়ছে। যেটা বাড়ে, সেটা আর কমে না। এক কেজি চাল ৭৫ টাকা। ওই যে বাড়লো, আর কমলো না। প্রতিটা বাজারেই একই অবস্থা। আমরা এই সিন্ডিকেট থেকে কবে পরিত্রাণ পাবো তার কোনো ঠিক নেই। হাতিরপুল বাজারে কথা হয় মিরাজ হোসেন নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শিশুখাদ্য এমন কিছু নেই যে তার দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশের মতো বাজারে মানুষের এই জিম্মিদশা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের অনেক রকম লজিস্টক সমস্যা রয়েছে। তারপরও আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছি। যেখানে যেটুকু করার তার সবটুকুই করছি। কিন্তু শুধু আমরা রাত-দিন কাজ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো না। ভোক্তা অধিকার ছাড়াও বাজার সংশ্লিষ্ট সকলকে এই বিষয়ে আন্তরিকভাবে মাঠে নামতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া কারও একার পক্ষে বাজার ব্যবস্থার সুদিন আনা সম্ভব নয়।