ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে দাম কমছে, দেশের বাজারে উল্টো
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ৪:৪০ অপরাহ্ণ
বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় দেড় বছর ধরে কমছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে তার কোনো সুফল মিলছে না। বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মাসভিত্তিক ফুড প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে খাদ্যের মূল্যসূচক অনেক কমেছে। গত বছরের মার্চে এই সূচক রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার পর জুলাই মাসে তার মান প্রায় ৩৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। অন্যদিকে সরকারি বাজার যাচাইকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ২৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এফএও ফুড প্রাইস ইনডেক্স বলছে, জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যসূচক ১২৩ দশমিক ৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে। রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চ মাসে এই সূচক রেকর্ড ১৫৯ দশমিক ৭ পয়েন্টে উঠেছিল। এরপরের চার মাসেও এর মান ১৫০-এর উপরে ছিল। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে তা ১৪০ এর ঘরে নেমে আসে। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা কমে ১৩০ দশমিক ২ পয়েন্ট হয় এবং জুন মাসে তা আরও কমে ১২২ দশমিক ৪ পয়েন্টে নেমে আসে।
এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম অনেক কমেছে।
গত বছরের জুলাই মাসে ভোজ্য তেলের মূল্যসূচক ছিল ১৬৯ পয়েন্ট। চলতি বছরের জুলাই মাসে মূল্যসূচক ৩৯ পয়েন্ট কমে ১৩০-এ নেমে এসেছে। একই চিত্র দেখা গেছে দুগ্ধপণ্যের মূল্যসূচকেও। চলতি বছরের জুলাইয়ে দুগ্ধপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ১১৬ দশমিক ৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে এফএও, যা আগের বছরের জুলাই মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
গত মাসে আমিষ পণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচকও কমেছে। গত বছরের জুলাইয়ে আমিষ পণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ছিল ১১৭ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। চলতি বছরের জুলাই মাসে এই মূল্যসূচক কমে ১১৭ দশমিক ৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আমিষ পণ্যের এই সূচকমানে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। এ ছাড়া দানাদার শস্যের মূল্যসূচকও কমেছে জানিয়ে এফএও বলছে, দানাদার শস্যের মূল্যসূচক এক বছরে ২১ দশমিক ৪ পয়েন্ট কমে ১২৫ দশমিক ৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে। গত বছর জুলাইয়ে দানাদার শস্যের মূল্যসূচক ছিল ১৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে বিশ্ববাজারে চিনির মূল্যসূচক এখনো কমেনি। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের তুলনায় চিনির মূল্যসূচক কিছুটা কমলেও গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায়বিশ্ববাজারে এই পণ্যটির মূল্যসূচক বেড়েছে। যদিও বিশ্ববাজারের চেয়ে বাংলাদেশে চিনির মূল্য বৃদ্ধির হার অনেক বেশি।
এদিকে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও তার সুফল মিলছে না দেশের বাজারে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম। সরকারি বাজার যাচাইকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ২৪২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
টিসিবি বলছে, এক বছর আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৯০ টাকা। বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। বছরের ব্যবধানে এই পণ্যটির দাম ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের ব্যবধানে ভোজ্য তেলের দাম বিশ্ববাজারে ৩৯ শতাংশীয় পয়েন্ট কমলেও দেশীয় বাজারে সেভাবে কমেনি। ভোক্তাদেরকে এখনো এক লিটার ভোজ্য তেল কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১৭৫ টাকা। এ ছাড়া এক কেজি আটা কিনতে ভোক্তাকে এখনো ৫৫ থেকে ৬০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
ওদিকে টিসিবি বলছে, বছরের ব্যবধানে রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৮০ টাকা। গত বছরে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া রসুনের দাম এখন ২৬০ টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম ২৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে বর্তমানে এক কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৮০ টাকা দরে, এক বছর আগে এই পণ্যটির দাম ছিল ৫০০ টাকা। বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি জিরার দাম বেড়েছে ৬৮০ টাকা। এক বছর আগে ১৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া আদার কেজি এখন সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। এই পণ্যটির দাম কেজিতে ২৬০ টাকা বেড়েছে। বাজারে দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়, এক বছর আগে যার দাম ছিল সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। ফলে বছরের ব্যবধানে দেশি পিয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানিকৃত পিয়াজের দামও ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত রসুনের দাম ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪০ টাকা হয়েছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় বাজারে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্ব অর্থনীতির খারাপ অবস্থা কেটে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের আরও প্রকট হচ্ছে। এর কারণ অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কারণ তাদের গতিবিধিতেই বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে। একজন বাজার বিশেষজ্ঞ বলেন, পত্রিকায় খবর আসে অর্থমন্ত্রী নিয়মিত অফিস করেন না, অর্থসচিব কারও সঙ্গে কথা বলেন না, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেখা দেন না। এনবিআর চেয়ারম্যানকেও পাওয়া যায় না। এতে বোঝা যায় অর্থনীতি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় বাজার এবং সার্বিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার উন্নতি সম্ভব না।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা অতি মুনাফাকে জায়েজ করার জন্য বন্যা, খরা, ডলার সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধের মতো অজুহাত সামনে আনছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব অজুহাতের কোনো বাস্তবতা নাই। তিনি বলেন, আগে যারা কারসাজির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এজন্য দাম বাড়ানোর সংস্কৃতি সামাজিক সংক্রামকে রূপ নিয়েছে। আমরা ভোক্তারা অসহায় হয়ে গেছি। এখান থেকে উত্তরণের পথ আমরা জানি না।
মানবজমিন