ভয়াল একুশে আগস্ট: সেই হরকাতুল জিহাদ এখনও বৃহত্তর সিলেটকে কেন্দ্র করে সক্রিয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২৩, ৪:০৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশ। সংক্ষেপে ডাকা হয় হুজিবি নামে। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল এই সংগঠনের সদস্যরা। এরপর শীর্ষ নেতাদের কারও কারও ফাঁসি হয়, অনেকেই হয় গ্রেফতার। এরপর এখনও সক্রিয় রয়েছে সংগঠনটি। জঙ্গি প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মাঝখানে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও কয়েক বছর ধরে হুজিবি সদস্যরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে মিলিত হয়ে নাশকতার চেষ্টা করছে হুজিবি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশ গঠন করেছিলেন যশোরের মাওলানা আব্দুর রহমান ফারুকী। ওই বছরই তিনি যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান। এরপর আফগানিস্তান ফেরত মুজাহিদদের নিয়ে ১৯৯২ সালে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে হুজিবি। সে সময় এর নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আব্দুস সালাম। প্রথম দিকে সংগঠনটি দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে। নব্বই দশকের শেষের দিকে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে বাংলাদেশে বর্তমানে নিষিদ্ধ হওয়া এই জঙ্গি সংগঠন।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে হুজিবি মূলত নাশকতা চালাতে থাকে। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি হুজিবির সদস্যরা কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা চেষ্টা করে। এরপর একই বছরে ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে। ৮ অক্টোবর খুলনার আহমদীয়া জামে মসজিদে হামলা চালায়। ২০০০ সালে হুজিবির সদস্যরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চলায়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে হামলাসহ নেত্রকোনার একটি গির্জা, ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে হামলাসহ একাধিক হামলা ঘটায়।
তবে হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। নারকীয় এই হামলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরোটা সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে মদত পেয়েছে এই জঙ্গি সংগঠন। এমনকি একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালালেও হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করেনি তৎকালীন সরকার। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে। ২০০৯ সালের পর থেকে সেই অভিযান আরও জোরদার করা হয়। এরপরই কোণঠাসা হয়ে পড়ে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী- বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদের অনেক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ বেশ কয়েকজনের বিচার শেষে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে এখনও হরকাতুল জিহাদের অনেক নেতা পলাতক থেকে সংগঠনকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই কারাবন্দি থাকা অবস্থায়ই চালিয়ে যাচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি পাহাড়ে কার্যক্রম চালানো নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিন্দাল শারক্বিয়াও গঠন করা হয় কারাবন্দি হুজি নেতা মাওলানা আবু সাঈদের পরামর্শে। জিজ্ঞাসাবাদে জামাতুল আনসারের শীর্ষ নেতা শামীন মাহফুজ জানিয়েছে, কারাগারে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে হুজিবির শীর্ষ নেতা মাওলানা আবু সাঈদের পরিচয় হয়। তার পরামর্শেই পাহাড়ে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করেছিল সে।
সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, হরকাতুল জিহাদ এখন কয়েকটি অংশে ভাগ হয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। একটি অংশ এখন রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মিশে গেছে। একটি অংশ নিজেরাই গোপনে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর অন্য অংশটি আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলেও পলাতক থেকে তৎপরতা চালাচ্ছে, অনেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে আছে।
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার এস এম নাজমুল হক বলেন, হুজি এখন সুপ্ত অবস্থায় আছে। ভেতরে ভেতরে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের নিয়মিত নজরদারি করছি। আফগান ফেরত অনেক মুজাহিদ এখনও বিভিন্ন ছদ্মবেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। আমরা তাদেরও নজরদারি করছি।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, হুজিবি এখনও বৃহত্তর সিলেটকে কেন্দ্র করে সক্রিয় রয়েছে বেশি। এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগও বেশি। এছাড়া সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও ব্যাপক দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়েছে। এমনকি তাদের একটি গ্রুপ আরাকানেও তৎপর রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন