দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ৩ শ্রেষ্ঠ জয়িতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফলতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৩, ৬:৫৪ অপরাহ্ণ
জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ-২০২২ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় তিন ক্যাটাগরীতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নির্বাচিত ৩ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতকে সম্মানা প্রদান করা হয়েছে। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গত ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ৩ জন নির্বাচিত জয়িতাদের উত্তরীয়, সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুসরাত লায়লা নীরাসহ অতিথিবৃন্দ।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় তিন ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত জয়িতারা হলেন- অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী লিজা বেগম, সফল জননী মোছাঃ হোসনা বেগম, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় কোহিনুর বেগম খুকি।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা- লিজা বেগম দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা একজন দিনমজুর। বাবার রোজগার দিয়ে কোন মতে সংসার চলত। সংসারের এই অভাব-অনটন দেখে তিনি অভাব ঘুচাতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরতে একটি বেসরকারী সংস্থা থেকে হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেড়াকে টিকা দানের প্রশিক্ষণ নেন। দক্ষিণ সুরমা প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে টিকা ও ঔষধ সংগ্রহ করে ভ্যাকসিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন।
পাশাপাশি এস,এম,সি’র বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। তিনি গ্রাম পর্যায়ে ভ্যাকসিনেটর ক্যাম্প করে মাসে ভাল টাকা উপার্জন করেন। বর্তমানে এটিকে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া এবং বড় ভাইকে ফার্মেসীর ব্যবসা করাচ্ছেন। বসবাসের জন্য নিজের উপার্জন দিয়ে ৪ রুমের একটি ঘর তৈরি করেছেন। এছাড়াও ৭টি গরু, ১০টি হাঁস, ৬০টি মোরগ-মুরগি ক্রয় করে খামার করে বর্তমানে স্বচ্ছল। পাশাপাশী তিনি নকশী কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করেন। এখন তিনি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করেন। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়ে এলাকার অনেক মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। লিজা বেগম সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের হতাশাগ্রস্থ নারীদের জন্য উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
সফল জননী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা মোছাঃ হোসনা বেগম একজন নি¤œবিত্ত অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। দিনমজুর স্বামীর ঘরে তাদের পরিবার ভালই চলছিল। তিনি চার সন্তানের জননী। ২০১৫ সালে তার স্বামী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ৪ বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর চার সন্তান নিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাদের সংসার চালানোর মত কেউ ছিলনা। তিনি সূর্য্যরে হাসি ক্লিনিকে সিএসপি পদে চাকরী করে সংসারের হাল ধরেন। পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করেন। তার বড় মেয়েকে এইচ.এস.সি পাশ করার পর বিয়ে দেন। ছোট মেয়ে সরকারি মহিলা কলেজ বি.এ পড়ছেন। তার ২ ছেলে নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজে প্যাথলজি বিভাগে চাকরি করেন, পাশাপাশি তারা তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বহুকষ্টে পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে মোছাঃ হোসনা বেগম আত্মবিশ্বাস ও প্রচেষ্টায় নিজের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং জীবনমান উন্নত করার কাজে এগিয়ে আসায় মোছাঃ হোসনা বেগম একজন সফল জননী।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা কোহিনুর বেগম খুকি গরীব ঘরের সন্তান। তিনি ২০০১ সালে এস.এস.সি পাশ করে আর বেশী লেখাপড়া করতে পারেননি। ১৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। তিনি ২ সন্তানের জননী। ছোটবেলা থেকে সমাজের মানুষের জন্য কিছু করতে চান। মানুষের সুখ-দুঃখে তিনি এগিয়ে যান। তার ছোট ছেলের বয়স যখন ৯ বছর তখন তার স্বামী স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে যান। চিকিৎসা করেও স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি। তখন থেকে তিনি পরিবারের হাল ধরেন। তিনি প্রথমে ২টি গাভী ক্রয় করে গরুর খামার করেন, বর্তমানে তার ১৯টি গরু আছে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে জীবন দক্ষতায় প্রশিক্ষণ নেন, সেই প্রশিক্ষণ তাকে সমাজের মানুষের উন্নয়নে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। খোলা পায়খানা বন্ধের ব্যপারে মানুষকে বুঝান। ইউনিয়ন, উপজেলায় নিয়মিত যাওয়া আসা করেন সেই সুবাদে তিনি মানুষকে বিভিন্ন সরকারী অনুদান তথা বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, ভিডব্লিউবি কার্ড ইত্যাদি ভাতা পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। তিনি বাল্য বিবাহ বন্ধের ব্যপারে সমাজের নারী ও কিশোরীদের নিয়ে সমাবেশ করে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেন। তিনি সমাজে অবহেলিত ও নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা পেতে সাহায্য করেন। ভবিষ্যতে তিনি জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের জন্য আরো কাজ করতে চান। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও সফলতার কারণে এলাকার লোকজন তাকে খুব স্নেহ করে। তাই তো কোহিনুর বেগম খুকি একজন সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছেন।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খাদিজা খাতুন বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ৩ জন জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা প্রদান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় সফল জননী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা রোশনা বেগম’র বয়স ৭০ বছর। তিনি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও ইউনিয়নের কচুয়া বহর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবারে মেয়েদের পড়ালেখা করতে দেয়া হতো না। লেখাপড়ায় আগ্রহ থাকা সত্বেও তিনি পড়ালেখা করতে পারেননি। তার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিলো না। অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেন। তার স্বামী একজন দরিদ্র কৃষক ছিলেন। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এমনকি তারা দিনে এক বেলা খাবার খেতে পারতো। এর মধ্যে ছেলে-মেয়ে জন্ম নিলে পরিবার বড় হতে থাকে। শুরু হয় রোশনা বেগমের জীবন যুদ্ধের কঠিন সংগ্রাম। হাঁস, মুরগী, ছাগল ও গরু বর্গা নিয়ে পালন শুরু করেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠেন একজন সফল খামারী। সন্তানদের পড়াশুনা করাতে তার আর বেগ পেতে হয়নি। সন্তানদের ধৈর্য ও তার অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে আজ তার সন্তানরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি একজন সফল জননী।
বড় ছেলে এস,এস,সি পাশ। বর্তমানে কন্সট্রাকশনের ঠিকাদার, দ্বিতীয় মেয়ে- এস এস সি পাশ। বর্তমানে বিবাহিত। তৃতীয় ও চতুর্থ দু’জন ছেলে- বি এ পাশ। বর্তমানে ফ্রান্সে আছে। পঞ্চম ছেলে- বি এ পাশ । বর্তমানে স্পেন আছে। ষষ্ঠ ছেলে ডাক্তার। বর্তমানে ডিগ্রী লাভের জন্য লন্ডনে আছে। সপ্তম মেয়ে- এইচ এস সি পরিক্ষার্থী, অষ্টম মেয়ে- এইচ এস সি শিক্ষার্থী।