এরদোয়ানের জয় পশ্চিমাদের কাছেও কেন বড় বিষয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:১৪:২৩,অপরাহ্ন ৩০ মে ২০২৩
তুরস্কে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রোববার নির্বাচনে জয়ের পর তাঁকে অভিবাদন জানাতে দেরি করেননি শীর্ষস্থানীয় বিশ্বনেতারা। তাঁদের তৎপরতায় এটা স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কৌশলগতভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তুরস্ক। দেশটির এই অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে।
এরদোয়ানকে শুভেচ্ছা জানানো বিশ্বনেতাদের মধ্যে প্রথমেই বলা চলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথা। তিনি তো ভোটের আনুষ্ঠানিক ফল আসা পর্যন্তও অপেক্ষা করেননি। শুভেচ্ছাবার্তায় এরদোয়ানকে ডেকেছেন ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে। বলেছেন, নির্বাচনে এই জয়ের একটি কারণ এরদোয়ানের ‘স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি’।
পুতিনের এমন প্রতিক্রিয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তুরস্ক, বিশেষ করে এরদোয়ানের সঙ্গে ক্রেমলিনের সখ্য বেড়েছে। কারণ, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়ার পরেও ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের বিরুদ্ধাচরণ করেননি তিনি। যদিও ন্যাটোর অন্য সদস্য দেশগুলো মস্কোর ঘাড়ে নানা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে। এই ন্যাটোর হয়েই বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযানে অংশ নিয়েছে তুরস্ক।
এরদোয়ানকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাকে মোটেও ভালোভাবে নেননি এই দুই নেতা। ক্ষমতায় থাকার দুই দশকে তুরস্কে বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের রীতিনীতির ওপর এরদোয়ানের হস্তক্ষেপ নিয়েও মাথাব্যথা রয়েছে তাঁদের।
তবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার পরেও ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়েছেন এরদোয়ান। রাশিয়ার বাধার মুখে থমকে যাওয়া ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি আবার চালু করতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এতে করে ওই শস্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর সরবরাহ জারি থেকেছে। আরও বড় কথা, দীর্ঘদিন দোটানায় থাকার পর রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন এরদোয়ান।
এরদোয়ান এককালে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত করতে জোর তৎপরতা চালিয়েছিলেন। এখন তিনি বলছেন, ‘তুরস্ককে আবার মহান বানানোর’ কথা। এ লক্ষ্য পূরণে তিনি বেছে নিয়েছেন আরও স্বাধীন একটি পররাষ্ট্রনীতি। এর ফলও পেয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেছে তুরস্ক।
ফিনল্যান্ডের পর এবার সুইডেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিকে জোটে আনা গেলে বাল্টিক সাগর ন্যাটোর সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে চলে আসবে। তবে সুইডেনকে সদস্যপদ দেওয়া নিয়ে বাদ সেধেছে জোটের অপর দুই সদস্যদেশ তুরস্ক ও হাঙ্গেরি। এমন পরিস্থিতিতে সুইডেন নিয়ে এরদোয়ানকে রাজি করাতে তৎপর হয়েছে ওয়াশিংটন।
এরদোয়ানকে বাগে আনতে একটি বিষয়কে সুযোগ হিসেবে দেখছে পশ্চিমারা। সেটি হলো তুরস্কের নড়বড়ে অর্থনীতি। পশ্চিমা দেশগুলোর ধারণা, দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার দিকে নজর দেবেন এরদোয়ান। অর্থনীতি চাঙা করতে বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টাও করবেন। এসব সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে এরদোয়ানের কাছ থেকে সুইডেনের বিষয়ে সম্মতি পাওয়ার আশা করছে পশ্চিমারা।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এমানুয়েল মাখোঁ। ২০১৫ সালে অভিবাসন সংকটের সময় ১০ লাখের বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে প্রবেশ করেছিল। বেশির ভাগই ছিল সিরীয়। এই অভিবাসন সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব এরদোয়ানের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পাওয়ার আশা করছেন মাখোঁ।
যদিও অভিবাসন সমস্যা সমাধানে আগেই তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। চুক্তিতে বিপুল অর্থ ও তুরস্কের নাগরিকদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ভিসা ছাড়া প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বিনিময়ে এরদোয়ান বলেছিলেন, বৈধ নথিপত্র ছাড়া কোনো অভিবাসীকে তুরস্কের জলসীমা ত্যাগ করে ইউরোপী ইউনিয়নের দিকে যেতে দেওয়া হবে না। তবে রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের এরদোয়ান কারাদণ্ড দিচ্ছেন—এমন অভিযোগে ভিসা ছাড়া তুরস্কের নাগরিকদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া নিয়ে চুক্তির শর্তটি পুরোপুরি বাস্তবে আসেনি।
এদিকে আজিয়ান সাগরকে কেন্দ্র করে এরদোয়ানের সঙ্গে বিরোধ চলছে ইউরোপীয় ইউনিয়দের দেশ গ্রিসের। আর প্রায় ৫০ বছর আগে তুরস্কের এক সামরিক অভিযানের পর সাইপ্রাস ভাগ নিয়ে চলমান একটি সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রীয় (তুরস্ক ও গ্রিস) সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন এরদোয়ান। এতে তুরস্কের ওপর ক্ষুব্ধ সাইপ্রাস। এসব বিষয় নিয়ে তুরস্ক ঘিরে রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
দীর্ঘ সময় ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করতে তুরস্ককে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে আসছে পশ্চিমারা। তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তুরস্ক নিয়ে পশ্চিমাদের ওই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এরদোয়ানের তৃতীয় মেয়াদে পা রাখার মধ্য দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো তেমন কোনো বদল আসবে না বলেই মনে হচ্ছে। তবে কৌশলগত অংশীদারেরা আঙ্কারার ওপর গভীর নজর রাখছে। এখন ভবিষ্যতে কী হবে, তা নির্ভর করছে তুরস্কের ওপরেই।