চেপে ধরেছে বাজার : নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১:০০:৫৪,অপরাহ্ন ২৩ মে ২০২৩
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছেই। সাম্প্রতিক সময়ে তেল এবং চিনির মূল্য বাড়ানোর পর এখন আবার অব্যাহতভাবে বাড়ছে পিয়াজের দাম। এর সঙ্গে থেমে নেই চাল, আটা, ময়দা, ডাল, আলু, আদা, রসুন, ডিম, মুরগি, মাছ, লবণ, মাংস ও শাক-সবজির দাম। প্রতিদিনই দাম বাড়ায় উদ্বেগে ফেলছে ক্রেতাদের। আগে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, তা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। আবার সরকারের বেঁধে দেয়া দামও মানা হচ্ছে না। এর মধ্যে চিনি, পিয়াজ ও সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে সরকারও। এ ছাড়া দাম সমন্বয়ের নামে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম প্রতি মাসেই ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হচ্ছে, যা সংসারে ব্যয়ের চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিমুখী চাপে চিড়েচ্যাপটা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত।
জানা গেছে, দেশে কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারে চাল, ডাল, পিয়াজ ও ভোজ্য তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই গত কয়েক সপ্তাহে বেড়েছে।
এ ছাড়া মসুর ডাল, আদা, চিনি, ভোজ্য তেলÑসব কিছুরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমনকি সবজি, মুরগি এবং মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এর মধ্যে খুচরায় প্রতি কেজি পিয়াজ ১২ থেকে ১৫ টাকা এবং পাইকারিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। আকারে তুলনামূলক ছোট ও ক্রস জাতের পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকায় এবং দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা দরে। পিয়াজের দাম এক মাসে বেড়ে গেছে দ্বিগুণের বেশি। এক মাস আগেও রাজধানীর বাজারগুলোতে পিয়াজের কেজি ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভারত থেকে পিয়াজ আমদানির হুমকি দেয়ার পরও দাম কমছে না। সম্প্রতি পিয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
রাজধানীর মালিবাগ বাজারের মুদি দোকানদার আনোয়ার বলেন, আমাদের আসলে করার কিছু নাই। আমাদেরও তো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। যারা আমদানি করেন, তারাই দাম বাড়াচ্ছেন। কিন্তু কেন দাম বাড়াচ্ছেন সেটা বলতে পারছি না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। খবরের কাগজে দেখলাম, দেশে চাল-ডাল- তেলের যথেষ্ট মজুত আছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কম।
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৪০ টাকা, এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৯ টাকা, চালের কেজি মানভেদে ৬০ থেকে ৭৮ ও পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। মানভেদে দেশি আদার কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, আমদানি করা আদা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। মাসখানেক আগেও আদা বিক্রি হতো ১৪০ টাকায়। এ ছাড়া আমদানি করা রসুনের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।
এদিকে দেশে পিয়াজের বাম্পার ফলন হলেও দামের ক্ষেত্রে এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বছরে ২৫ লাখ টনের চাহিদার বিপরীতে চলতি অর্থবছরে পিয়াজের উৎপাদন ৩৬ লাখ টনের বেশি হবে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। তারপরও বাজারে প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, স্থানীয় বেপারিরা সরবরাহ কমিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করছেন।
অন্যদিকে আলুর সংকট না থাকলেও দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এক মাস আগেও কেজিতে দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও গত এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম ২৯ শতাংশ, আর বছর ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। গত বছরের এই সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ১৮ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে, যা এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আলুর মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ছাড়া ডিমের হালি ৫০, সোনালি মুরগির কেজি ৩৬০, ব্রয়লার ২৪০, গরুর মাংসের কেজি (হাড়সহ) ৮০০ ও খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকায়। মাছের দামও বাড়তি। ছোট মাছের কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, রুই, কাতলা, জীবিত মাছের কেজি আকারভেদে ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা। পেঁপের কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। লম্বা বেগুন, ঢ্যাড়স, ঝিঙা, জালি, মুলা, কাঁকরোল, টমেটোর কেজি ৬০ টাকা, গোল (তাল) বেগুন, লতি, করলা, বরবটি, গাজার, পটোলের কেজি গড়ে ৮০ টাকা। শাকের আঁটি পরিমাণ কমে ১০ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবি’র তথ্যানুযায়ী, বাজারদরের তালিকায় পিয়াজ, আদা, ডিম ও কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে।
বাজার করতে এসে শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে। শফিকুল ইসলামের মতো রাজধানীর মধ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি বড় চাপ তৈরি হয়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রংপুরের নোমান সরকার। মাসিক বেতন সাকুল্যে ৩৫ হাজার টাকা। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাড্ডায় বাসাভাড়া করে থাকেন তিনি। জানতে চাইলে নোমান বলেন, মাস শেষে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ বাসাভাড়া দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা। বেতন অনিয়মিত হওয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে টাকা এনে সংসার চালাতে হয়েছে। এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে। সঞ্চয় তো দূরে থাক, কীভাবে সংসার চালাবো, সেটি নিয়ে ভেবে কোনো কূল পাচ্ছি না।
প্রয়োজনীয় সবজির চড়া দাম প্রভাব ফেলেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাদের দৈনন্দিন খরচেও। রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারে আসা দিনমজুর রফিক মিয়া বলেন, ঈদের পরপরই বেড়েছে ডিম, ভোজ্য তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। এবার বাড়লো আলুর দাম। তিনি বলেন, অন্য সবজি না কিনতে পারলেও আগে আলু খাওয়া যেতো। এখন সেই পরিস্থিতিও নেই। গরিব মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে সেটা কেউ ভাবে না।
এদিকে সমন্বয়ের নামে প্রতি মাসেই দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাহী আদেশের কারণে যাচাই বাছাই বা সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জের সুযোগ থাকছে না। ফলে গ্রাহকের নাভিশ্বাস উঠছে। আইনে সংশোধনী আনার পর জানুয়ারিতে ১৮ দিনের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় দুই দফায়। প্রতিবার ৫ শতাংশ করে একমাসের ব্যবধানে ভোক্তার কাঁধে চাপানো হয় ১০ শতাংশেরও বেশি বাড়তি দামের বোঝা। এর মধ্যে আবার আবাসিক-সিএনজি বাদে বাকি সব খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। কোনো কোনো খাতে বৃদ্ধির হার ছিল ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত। আর এ ঘোষণার সবগুলোই গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে এসেছে।
কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা আকরাম হোসেন বলেন, স্বামী-স্ত্রী, ২ সন্তানের সংসার। খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে সর্বোচ্চ খরচ ১০ হাজার টাকা। পাঙ্গাশ মাছ আগে কখনো খাইনি। খরচ বাঁচাতে গত ৪ মাসে বহুবার পাঙ্গাশ খেয়েছি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেলাপিয়াও। তিনি বলেন, গত এক মাসে একবারও মাংস কিনিনি। মাংস কিনতে গেলে অন্যান্য জিনিস কেনা কঠিন। গত ৩ মাসে আত্মীয়দের কাছ থেকে ৫টি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়েছি। এর মধ্যে ৪টিতে যাইনি।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা ছাড়া দাম কমানোর কোনো উপায় নেই। ভোক্তারা এখন জিম্মি।