সিসিক নির্বাচন: মনোনয়নপত্র সংগ্রহের আগেই দুই চৌধুরীর কাদা ছোড়াছুড়ি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০১:৩৩,অপরাহ্ন ০৭ মে ২০২৩
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুরু হলেও বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হবেন কি-না দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও এখনো মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেননি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
তবে মাঠে গণসংযোগে ব্যস্ত আছেন আরিফ এবং আনোয়ারুজ্জামান। মনোনয়ন সংগ্রহের আগেই এই দুই চৌধুরীর মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। উভয়ই একে অপরের শিকড় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কে সিলেটের, কে বহিরাগত এটা নিয়েই চলছে দুজনের বাহাস।
মেয়র আরিফ ও আনোয়ারুজ্জামানের এই বাহাস প্রবাস থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা, বহুল আলোচিত সিলেটের বর্ষীয়ান রাজনীতিক বাবরুল হোসেন বাবুল।
গত সোমবার শ্রমিক দল আয়োজিত সভায় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নাম উল্লেখ না করে ইঙ্গিতে তাকে ‘বহিরাগত’ বলে মন্তব্য করেন। ওই রাতেই আরেক অনুষ্ঠানে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও আরিফকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে পালটা বক্তব্য দেন।
পালটাপালটি এমন অভিযোগের ব্যাপারে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আঞ্চলিকতার ধুয়া তোলার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমি নিজেই নানা বাড়িতে থাকি। মাঠের, রাজপথের খেলোয়াড়রা প্রার্থী নেই কেন এমন প্রশ্নই তুলেছিলাম। আমার প্রার্থী হওয়া নিয়েইবা তাদের এত ইন্টারেস্ট কেন? নির্বাচনের আগে কেনইবা আমার দলের ১৬ নেতাকর্মীকে অহেতুক গ্রেফতার করা হলো? তিনি বলেন, উন্নয়নের হিস্যা অবশ্যই নগরবাসীকে দেব। ২০ মে কথা হবে, দেখা হবে রাজপথে।
এমন কাদা ছোড়াছুড়ি প্রসঙ্গে নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সিলেট নগরীতে শুধু সিলেটের মানুষই থাকেন না। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ থাকেন। নির্বাচনে কার বাড়ি কোথায় এটা দেখে কেউ ভোট দেন না। আর যদি বলতেও হয়, বলতে পারব আমার চৌদ্দগোষ্ঠীই সিলেটের, এমনকি শ্বশুড়বাড়িও। মূলত কোন প্রার্থী কী উন্নয়ন করবেন নগরবাসী সেটা দেখেই ভোট দেন, দেবেন। গত ১০ বছরে মেয়রকে সরকার প্রায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু এত টাকা উন্নয়নে ব্যয় হলে নগরীর রাস্তাঘাটের ভগ্নদশা, জলাবদ্ধতার অবসান হয় না কেন? নগরবাসী এসব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
সিলেটের রাজনীতির মাঠে স্থানীয়-বহিরাগত নিয়ে ৮০-৯০ এর দশকেও প্রশ্ন উঠেছিল। এই ইস্যুতে তৎকালীন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুল সিলেট তথা দেশে-প্রবাসে আলোচিত হয়েছিলেন। বাবুল এখন সপরিবারে প্রবাসে। আরিফ-আনোয়ারুজ্জামানের স্থানীয়-বহিরাগত ইস্যুতে প্রশ্ন করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না, নো কমেন্ট। তবে তার ঘনিষ্ঠরা জানালেন, তিনি সার্বক্ষণিক সিসিক নির্বাচনের খোঁজখবর নিচ্ছেন। নগরীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ রাজনীতিকসহ একটি মহল বাবুলকে দেশে ফিরে মেয়র পদে প্রার্থী করার জন্য চাপের মুখে রেখেছেন। এ ব্যাপারে বাবুল যুগান্তরকে বলেন, প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে। তবে নির্বাচনের নামে টাকার খেলা হলে আমি নেই।
নির্বাচনি মাঠে বাহাস চললেও সিলেটের মেয়র বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচন করবেন কি-না এখনো অনিশ্চিত। প্রার্থী হওয়া, না হওয়া নিয়ে তিনি দোটানায়। কারণ নির্বাচন বর্জন নিয়ে তার দল বিএনপি কঠোর অবস্থানে। মেয়র আরিফ সব হিসাব নিকাশ শেষ করে প্রার্থী হওয়া, না হওয়ার ব্যাপারে খোলাসা করবেন আগামী ২০ মে। সম্প্রতি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ অবস্থায় নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়ানো, প্রচারণার ধকল সহ্য করার মতো শারীরিক অবস্থাও তার নেই।
আরিফ প্রার্থী হলেই প্রবাসে থাকা বিএনপি নেতা বদরুজ্জামান সেলিমও প্রার্থী হবেন এটা নিশ্চিত। এমনকি আরিফ প্রার্থী না হলেও তিনি প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করছেন। অতীতেও তিনি আরিফের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন। প্রবাসে থাকা এই নেতা বলেন, প্রতিদিনই অসংখ্য ফোন আসছে, আমিও খোঁজ নিচ্ছি। দেখি কী হয়।
এদিকে একক প্রার্থী নিয়ে আ.লীগের প্রচারণার মধ্যে দেশে ফিরেই বুধবার মেয়র পদের মনোনয়নপত্র কিনেছেন আ.লীগের প্রবাসী নেতা আব্দুল হানিফ কুটু। তিনি সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও এরশাদ সরকারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। কুটুর স্ত্রী নাজনিন আক্তার কণাও ছাত্রলীগ নেত্রী থেকে এখন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী। দীর্ঘদিন ধরে মহিলা কাউন্সিলরও। এবারও কণা মনোনয়ন নিয়েছেন। কুটু যুগান্তরকে বলেন, নগরবাসী এখনো নেতৃত্বশূন্য হয়নি। সিলেট উড়ে এসে জুড়ে বসার জায়গা নয়। আমি প্রার্থী হয়েছি নগরবাসী ও অতীতের উত্তাল দিনের সহযোদ্ধাদের আহ্বানে। এই সিলেটে অতীতে কে কী করেছেন তা ভোটে নগরবাসী প্রমাণ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। শুক্রবার নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় সতীর্থদের নিয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে মতবিনিময় করেন কুটু। এরপর আজ শনিবার থেকে তার গণসংযোগ ও প্রচারণার মহড়া শুরু করার কথা।
আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে নির্বাচনে আসছে না বিএনপি : পরাজয়ের ভয়ে বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাইছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেছেন, এবার সিলেটসহ দেশের অন্য পাঁচ সিটি করপোরেশনে নৌকার পক্ষে গণজোয়ারের খবর তাদের অজানা নয়। তাদের অতীত কার্যক্রম জনগণের মনে আছে। তাদের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। শুক্রবার সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি সম্পাদকসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নানক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা অবশ্যই জয় পাবে। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা জানে জনগণ তাদের সঙ্গে নেই। কারণ, তাদের দুঃশাসনের স্মৃতি মানুষ ভোলেননি। এ অবস্থায় নিশ্চিত পরাজয়ের ভয়ে তারা নির্বাচনে আসতে চাইছে না। আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে কেউ নির্বাচনে না এলে আমাদের করার কিছু নেই।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ও জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মোহাম্মদ আলী দুলাল ও এটিএম হাসান জেবুলের পরিচালনায় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান, সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আশফাক আহমদ, অ্যাডভোকেট শাহ ফরিদ আহমদ, অ্যাডভোকেট নিজাম উদ্দিন, অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক, ড. আহমদ আল কবির, অ্যাডভোকেট শাহ মো. মোসাহিদ আলী, নাজনীন হোসেন, হাবিবুর রহমান হাবিব এমপিসহ জেলা আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন : সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত কর্মিসভায় সিসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ঘোষণা করেছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আহমদ হোসেন। মহানগর আওয়ামী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। কো- চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক সংসদ-সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, সদস্য সচিব মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান। এ ছাড়াও প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে কমিটির প্রথম সদস্য করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ঘোষিত পাঁচ সদস্যের এই কমিটি পরবর্তী সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবে।
পুলিশের ধড়পাকড়ে বিএনপির নিন্দা : সিলেটজুড়ে বিএনপির দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, বাসাবাড়ি, দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুলিশি তল্লাশির নামে হয়রানির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন মহানগর বিএনপির নেতারা। এক বিবৃতিকে অবিলম্বে আটক নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি, গ্রেফতার-নির্যাতন ও পুলিশি তল্লাশির নামে হয়রানি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জোর দাবি জানান সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাছিম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী।
যুগান্তর