৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বদলে যেতে পারে সিলেটের মানচিত্র : প্রাণ হারাবে প্রায় ১২ লাখ মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ২:০১:৪১,অপরাহ্ন ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিলেট। ফলে এখানে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। ৭মাত্রার ভূমিকম্প হলেই বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে সিলেটে। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে দিন দিন বাড়ছে আকাশছোঁয়া ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা। ভরাট হচ্ছে জলাধার। কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড় ও টিলা। এতে বাড়ছে ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির শঙ্কাও। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই ভেঙে পড়বে। অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে নগরীর শাহজালাল উপ-শহর, আখালিয়া, বাগবাড়ি, মদিনা মার্কেট প্রভৃতি এলাকা। বাণিজ্যিক ভবন ও ইমারতের পাশাপাশি নগরীতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তাছাড়া নগরীর ২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনও চিহ্নিত করেছিলো সিটি করপোরেশন।
ভূমিকম্প বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে বাংলাদেশ তিনটি ভূকম্পন বলয়ে বিভক্ত। এর মধ্যে এক নম্বর বলয়ে রিখটার স্কেলে সাত থেকে নয় বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই এক নম্বর বলয়েই সিলেটের অবস্থান। এই বলয়ে আরও রয়েছে ময়মনসিংহ ও রংপুর।
ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী ‘সিলেট অঞ্চল’ ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয় ভূকম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই সিলেট হতে পারে ধ্বংসস্তূপ। অন্যদিকে সিলেট সিটিতে অপরিকল্পিত নগরায়ন, নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে বড় ভূমিকম্প হলে এখানে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) চার বছর আগের এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটে এক লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের হিসাবে হোল্ডিংই আছে ৭০ হাজার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ ভাগ স্থাপনা ধসে পড়তে পারে। এতে প্রাণ হারাবে প্রায় ১২ লাখ মানুষ এবং ক্ষতি হবে ১৭ হাজার কোটি টাকার।
জানা যায়, ১৮৩৩, ১৮৮৫, ১৮৯৭, ১৯০৫, ১৯৩০, ১৯৩৪, ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালের বড় ভূকম্পনের মধ্যে দুটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল (এপি সেন্টার) সিলেটের জৈন্তার ভূগর্ভে। একই উৎপত্তিস্থল থেকে ঘটে যাওয়া ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটি ভূকম্পনের ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ মাত্রার বেশি।
এই ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনসহ সিলেট ও অসম অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটে।
১৯৫০ সালে আসামে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণে সিলেট অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ছিল। এই ভূমিকম্পটি ‘আসাম-তিব্বত আর্থকোয়েক’ নামে ইতিহাসে পরিচিত রয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৬।
বছর দশেক আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলঙ্কার একটি বিশেষজ্ঞ দল সিলেট নগরীর ছয় হাজার ভবনের ওপর জরিপ চালিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সিলেটের বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেগুলো ধসে পড়বে। পাল্টে যেতে পারে সিলেটের মানচিত্রও। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সিলেটের গ্যাস এবং তেলক্ষেত্রগুলো। কেবল গ্যাস ফিল্ডেই ক্ষতি হবে ৯ হাজার কোটি টাকার। পরিবেশ বিপর্যয়ও নেমে আসবে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বহু বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে, যেগুলো ভূমিকম্পের সময় ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে। তাতে প্রাণহানিও বাড়বে। কারণ, তখন ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে না।
শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক আরঙ্গা পোলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আখতার, অধ্যাপক ড. আপ্তাব আহমেদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাকসুদ কামাল, ড. জাহাঙ্গীর আলমসহ জাপান থেকে আসা আরও দুজন বিশেষজ্ঞ এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন।