সুনামগঞ্জ হাসপাতালের ‘সুলতান’ সুলেমান
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:১৪:০৩,অপরাহ্ন ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
সুনামগঞ্জ সদর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্টোরকিপার পদে চাকরি করছেন সুলেমান আহমেদ। তবে অন্য দশজন স্টোরকিপারের মতো তিনি কোনো সাধারণ কর্মচারী নন। তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। এ চক্রের বিরুদ্ধে হাসপাতালে রোগীর খাবার সরবরাহ ও মেডিকেল সামগ্রী কেনায় দুর্নীতি, ঠিকাদারি কাজে হস্তক্ষেপ এবং ওষুধ ও আসবাব বিক্রি ও পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাঁর দাপটের কারণে অনেকে তাঁকে ‘সুলতান’ সুলেমান বলে থাকেন।
পদ-পদবি না থাকলেও সবাই তাঁকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোক বলে চেনেন। সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর হাসপাতালের স্টোর রুম থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার ওষুধ খোয়া যায়। এতেও সুলেমানের নাম আসে। তাঁর হাতেই সদর হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে সুলেমান দাবি করেন, ‘সবই সুবিধাবঞ্চিত চক্রের অপপ্রচার। কিছু ঘটলে স্বপ্নেও তাঁরা আমার হাত দেখতে পান।’
তিনি এতটাই ধূর্ত যে, দুটি নাম ধারণ করেন- সুলেমান আহমেদ ও সুলেমান মিয়া।
২০০৪ সালে ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য সহকারীর চাকরি নিতে সুনামগঞ্জের ছাতকের ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের ঠিকানার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন সুলেমান। এখানকার সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা তাঁর এই নাগরিকত্ব ভুয়া দাবি করে বলেছেন, সুলেমানের বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে। ছাতকের চাকরি বাগিয়ে নিতে প্রতারণার আশ্রয় নেন তিনি।
ছাতকে ১২ বছর চাকরির পর সুলেমান নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রথমে সুনামগঞ্জ সদর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ফেরেন। স্বাস্থ্য সহকারী পরিদর্শক পদে থেকেই দায়িত্ব পেয়েছেন হাসপাতালের স্টোরকিপারের।
বর্তমান ভোটার তালিকা অনুযায়ী, সুলেমান আহমেদ সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরের বাসিন্দা। তাঁর বাবার নাম মো. ইয়াদ আলী, মা ফাতেমা শরীফ। জন্ম ১৯৮০ সালের ২০ মে। তবে ২০০২ সালে সম্পূরক ভোটার তালিকায় তিনি ছাতকের ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের শিবনগর গ্রামের বাসিন্দা। সেখানে তাঁর নাম সুলেমান মিয়া, বাবার নাম এয়াদ আলী, মা ফাতেমা বেগম। জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৮ এপ্রিল।
শিবনগরের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ২০০৪ সালের ৫ জুলাই ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডে চেয়ারম্যান শামস উদ্দিনের প্রত্যয়নপত্র নেন সুলেমান। সেটি জমা দিয়ে ওই বছরের ২১ আগস্ট ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারীর চাকরি নেন।
টানা দু’বার আফজলাবাদ ইউপির নির্বাচিত চেয়ারম্যান গয়াছ আহমদ জানান, শিবনগর গ্রামে এয়াদ আলীর ছেলে সুলেমান নামে কাউকে চেনেন তিনি। তৎকালীন চেয়ারম্যান শামস উদ্দিন বলেন, জালিয়াতি করে সনদ নিয়ে থাকতে পারে। এখানকার ইউপি সদস্য দিদার আলমও দাবি করেন, সুলেমান তাঁর গ্রামের বাসিন্দা নন।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০১৬ সালে সুলেমানকে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্টোরকিপার হিসেবে পদায়ন করেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল হাকিম। ২০১৮ সালে সেখান থেকে একই পদে ২৫০ শয্যার সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। এ জন্য সেখানকার স্টোরকিপারকে সরিয়ে দেন তখনকার সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ। সুলেমান সিভিল সার্জন অফিসের অফিস সহকারী ছমিরুল ইসলামের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চলে যাওয়ার পর ২০২১ সালে ছমিরুলকেও জেলা সদর হাসপাতালে হিসাবরক্ষক পদে টেনে নেন। এতে নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন।
সদ্য অবসরে যাওয়া সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, স্বাস্থ্য সহকারী থেকে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। পদোন্নতি দিয়ে স্টোর কিপার করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে তাঁর সময়ে অভিযোগ এলে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
দরপত্র নিয়ন্ত্রণ: গত ৩ নভেম্বর সুনামগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতালের ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এমএসআর ক্রয়ে ৪ কোটি ৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকার কার্যাদেশ পায় ঢালী করপোরেশন, ঈগল ইন্টারন্যাশনাল ও ফরচুন করপোরেশন। এর আগে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে হাসপাতালের প্রায় ১০ কোটি টাকার এমএসআর সরবরাহে দরপত্র দাখিলের দিন একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় টেন্ডার ডকুমেন্ট হাসপাতালের সামনে থেকে ছিনতাই হয়। পরে কৌশলে ঢালী করপোরেশনকে কাজ দেওয়া হয়। দুদক ও স্বাস্থ্য বিভাগে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, দুটি ঘটনাতেই সুলেমানের হাত রয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ দেওয়া শামীমা এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সাজিদুর রহমান বলেন, ‘সুলেমানের নেতৃত্বে হাসপাতালে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা বারবার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ নানা অপকর্মে জড়িত। অভিযোগ দিলেও কাজ হয় না।’
সুলেমান আহমেদ বলেন, ‘আমাকেসহ চারজনকে প্রয়োজন থেকে পদায়ন করা হয়। কোনো তদবির করিনি। দরপত্র সিন্ডিকেট বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো হাত নেই। ওষুধ পাচারের সঙ্গেও জড়িত নই।’সুত্র-সমকাল