সাহায্য চাইতে সাদ্দামের মিথ্যার আশ্রয়! কিন্তু কেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৪৪:৩৩,অপরাহ্ন ০৯ জানুয়ারি ২০২৩
ঠাণ্ডায় জবুথবু শহর। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। রাত ৯টা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে শহুরে মানুষ চায়ের কাপে চুমু দিচ্ছে। ভিড় নেই। স্বাভাবিক শহর। পেছন থেকে একটি ছেলের টোকা। ফিরে দেখা যায়, হাতে ছবি নিয়ে সাহায্যের হাত পেতে আছে ছেলেটি। বয়স ১১ কি ১২ হবে। নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় সাদ্দাম।
গ্রামের বাড়ি সুখানপুকুর নতুন পাড়া। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মধ্যে। বাবা মারা গেছে কিছুদিন আগে। বোনের ছবি ল্যামিনেশন বাঁধাই করা। নিচে লেখা তার দুটি কিডনি নষ্ট। চিকিৎসার জন্য সাহায্য করুন। বোনের নাম শাকিলা। মলিন চেহারার সাদ্দাম। এখনো শিশু। ঠিকমতো কথা উপস্থাপন এখনো আয়ত্তে আসেনি। সরাসরি পথচারীদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখিয়ে টাকা চায়। কেউ দেয় আবার কেউ দেয় না। মিনিট পাঁচেক কথা হয় সাদ্দামের সঙ্গে। একই কথা। বোনের কিডনি নষ্ট। চিকিৎসা করতে টাকা প্রয়োজন। হাসপাতালের অধীনে চিকিৎসা চলছে। বাবা নেই। মারা গেছেন। কষ্টের সংসারে হাবুডুবু খাচ্ছে মাসহ পরিবারের সদস্যরা। সন্ধ্যার আগে তাদের রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি লোকাল ট্রেনে বগুড়া শহরে আসে সাদ্দাম। হাত বাড়িয়ে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ায়। সাড়ে ১০টার পর সিএনজিতে ফিরে যায় বাড়ি। এভাবেই সপ্তাহে ৩-৪ দিন শহরে এসে টাকা সংগ্রহ করে। কথা বলার ফাঁকে পকেট থেকে ১০০ টাকার একটি নোট বের করে হাতে দেই সাদ্দামের কাছে ওদের পরিবারের মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে সে বলে তাদের কেউ ফোন ব্যবহার করে না। পকেট থেকে তখন ভিজিটিং কার্ড বের করে সাদ্দামকে তাদের এলাকার যে কারও ফোন থেকে কথা বলতে বলি। সে মিথ্যে বলছে না সত্য বলছে সেটি জানার জন্য এলাকার যে কারও সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে সাদ্দামকে নিয়ে একটা মানবিক স্টোরি লিখবো। ওদের আরও কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করবো। এমন উদ্দেশ্য নিয়েই ওর সঙ্গে এতক্ষণ সময় দেয়া। মোবাইল ক্যামেরায় একটা ছবিও তুলে রাখলাম। ভিডিও ক্লিপে ওর সাক্ষাৎকার ধারণ করলাম। এরপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমু দেয়া মানুষদের কাছে টাকা চাইতে চাইতে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকানো সাদ্দামের দিকে চোখ পড়লেই মন গলে যাবে বেশির ভাগ মানুষের। কমবেশি সবাই ২-৪ টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদ্দামের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে কোনো ভনিতা চোখে পড়েনি। তবুও সন্দেহ হলো। আসলেই কি ওর বোনের কিডনি নষ্ট? আসলেই কি সাদ্দামের বাবা বেঁচে নেই? সেকি সত্যি কথা বলছে? এমন সন্দেহ দূর করার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ফোনের। পরদিন সকালে ফোন দেয়ার কথা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। কোনো ফোন আসলো না। ফোন না পেলে সাদ্দামের ঠিকানা অনুযায়ী ওদের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক-দুই দিনের মধ্যেই যাবো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সাদ্দামের চেহারা। দিনের শেষে সন্ধ্যা নামে। একটু পরেই মাগরিবের আজান হবে। এমন সময় অপরিচিত একটা নম্বরে ফোন আসে। রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে আসে সাদ্দামের কণ্ঠ। আমি সাদ্দাম বলছি। গতরাতে সাতমাথায় আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আপনি ফোন দিতে বলেছিলেন। আমি সাদ্দামকে সহজেই চিনতে পারলাম। ওকে ফোনের মালিককে ফোনটি দিতে বললাম। একজন দোকানি। আব্দুল কাদের। সুখানপুকুর বাজারে তার দোকান। আমার পরিচয় আব্দুল কাদেরকে জানালাম। এরপর কাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম সাদ্দামকে চেনেন কিনা? তিনি বললেন সেভাবে চিনি না, তবে মাঝেমধ্যে সাহায্যের জন্য দোকানে আসে। আমার সাধ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করি। সেই সুবাদে চেহারায় চিনি। বিস্তারিত কিছুই জানি না। সাদ্দামের দেয়া তথ্যগুলো সঠিক কিনা খোঁজ নেয়ার জন্য আব্দুল কাদেরকে অনুরোধ করলাম। তিনি ঘণ্টাখানেক সময় চাইলেন বিস্তারিত জানানোর জন্য। আবারো অপেক্ষায় থাকলাম। সময়মতো আব্দুল কাদেরের আবারো ফোন। তিনি জানালেন সাদ্দামের বাবা মারা গেছেন ঠিক আছে কিন্তু বোনের কিডনির কোনো সমস্যা নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর সাদ্দামের মা আবারো বিয়ে করেছেন। সেই পক্ষের বাবার সঙ্গেই ওরা থাকে। আব্দুল কাদের আরও জানান, সাদ্দামের বোনের কোনো অসুখ না থাকলেও পরিবারে অভাব আছে। আব্দুল কাদেরের দেয়া তথ্য পেয়ে পুরো বিষয়টা খোলাসা হয়ে গেল। সাহায্য চাইতে এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অভাবির সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বিত্তবানদের দানের হাত গুটিয়ে নেয়া, সামাজিক অবক্ষয় নাকি সামগ্রিক অভাব বৃদ্ধি এর পিছনে কারণ? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যপক মোস্তফা কামাল সরকারের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সামগ্রিক আচার আচরণের ওপর। আমাদের এখানে উচ্চবিত্তদের দান খয়রাতের হাত খুবই দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের চিন্তার জায়গাগুলো আলাদা হয়ে গেছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে রিকশা, অটোচালকদের কথা উল্লেখ করেন। তারা মেঘের গর্জন শুনলেও ১০ টাকার ভাড়া বাড়িয়ে ২০ টাকা চায়। আবার একটু রোদ বেশি হলেও ভাড়া দ্বিগুণ চেয়ে বসে। এটা খুবই নীতিহীন কাজ। তিনি নীতিহীন কাজ করছেন তার আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখে। কারণ আমরা কমবেশি এখন সবাই নীতিহীন হয়ে উঠেছি। অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সরকার আরও বলেন, বাজারে যেদিন মাছের আমদানি বেশি হয় সেদিন মাছ ব্যবসায়ীরা তাদের কেনা দামের চেয়ে কম টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন। আমরা কিন্তু তখন দেখি না ওই ব্যবসায়ী লোকসান দিয়ে মাছ বিক্রি করলো। আমরা কমদামে কিনে জেতার উল্লাসে মেতে উঠি। এটাও একটা নীতিহীন কাজ করে বসি আমরা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিথ্যা ছেয়ে গেছে। কেউ কারও কথা বিশ্বাস করতে পারি না। সাদ্দাম আসলেই গরিব অসহায় একটি শিশু। তার বোনের কিডনির সমস্যা হয়নি। কিন্তু মিথ্যে না বললে হয়তো কেউ তাকে সাহায্য করবে না, এজন্যই সে ওইটুকু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। রাষ্ট্রকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ওই এতিম শিশুর দায়িত্ব নেয়ার কথা থাকলেও কোনো কারণে নিতে পারেনি। তাকে তো জীবন-জীবিকা চালাতে হবে। সে অনেকটা বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করছে দ্বারে দ্বারে। অপরদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ আছে তারা ধনী হওয়ার জন্যই মিথ্যা বলে মানুষের কাছে হাত পাতে। কিছুদিন আগে এক কোটিপতির খবর কমবেশি সবাই জেনেছে। মায়ের ক্যান্সারের মিথ্যা গল্প সাজিয়ে দানের টাকায় সে এখন কোটিপতি। সামাজিকভাবে হেয় হলেও ধনী হওয়ার নেশা তাকে নীতিহীন করে তুলেছে। সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজকেই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেন ওই সমাজ গবেষক।