একজন বড় মাপের চিন্তক ও দার্শনিক ছিলেন দেওয়ান আজরফ
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:৫৫:৩৪,অপরাহ্ন ১৮ ডিসেম্বর ২০২২
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খানঃ
জাতীয় অধ্যাপক, বহু গ্রন্থপ্রণেতা, বিশিষ্টি শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ দর্শন শাস্ত্রের সাধক ছিলেন। ইসলাম, নন্দনতত্ত¡, নীতিশাস্ত্র, যুক্তি, অধিবিদ্যা, সামাজিক দর্শন ও রাজনৈতিক দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের তার বিস্তর পড়াশোনা ছিল। জীবন ও জগৎ নিয়ে মৌল বিধানের আলোচক ছিলেন। মানব সমাজের প্রকৃত শান্তির পথ তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। নিপুণ সাহিত্যের ভাষায় সমকাল এবং চারপাশের মানুষ আর প্রকৃতি সম্পর্কেও বলে গেছেন।
দেওয়ান আজরফের সাথে তার জীবন ও দর্শন নিয়ে বহুবার একান্ত আলাপচারিতা ও তার লেখালেখি থেকে জানা গেছে, তিনি রাসূল সা:-এর অন্যতম সাহাবি হজরত আবুজর গিফারীর রা:-এর চিন্তার উত্তরাধিকারী ছিলেন। আবুজর আল-গিফারী আল-কিনানি, যিনি জুন্দুব ইবনে জুনাদাহ ইবনে সুফিয়ান নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি হলেন নবী মুহাম্মাদ সা:-এর সময়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে চতুর্থ বা পঞ্চম ব্যক্তি। তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন।
দার্শনিক আজরফ স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে যুক্তিনির্ভর ও কাঠামোগত বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করেছেন। ফিজিকস, মেটাফিজিকস, লজিক, এথিকস, পলিটিকস, পোয়েটিকস, রেটোরিকস প্রভৃতি দিক নিয়ে জীবন জিজ্ঞাসার জবাব প্রদানের বা সমাধানের চেষ্টা করেছেন।
বহু গ্রন্থ প্রণেতা, সুলেখক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা ১৩১৩ সনের ৯ কার্তিক শুক্রবার ইংরেজি ১৯০৬ সালের ২৫ অক্টোবর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া গ্রামে তার নানা মরমি কবি হাসান রাজার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেওয়ান মোহাম্মদ আসফ। তিনি দুহালিয়ার জমিদার এবং একজন জাতীয়তাবাদী জননেতা ছিলেন। মাতার নাম রওশন হুসেইন বানু। (হাসান রাজার জ্যেষ্ঠা কন্যা)। তিনি একজ বিদুষী মহিলা ছিলেন মাতহার দিক থেকেই দেওয়ংান মোহাম্মদ আজরফ মরমি কবি হাসান রাজার উত্তরাধিকারী।
দেওয়ান আজরফ দুহালিয়ার মধ্য ইংরেজি স্কুল, সুনামগঞ্জ জুবিলি হাইস্কুল, সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ফারসিতে লেটারসহ প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ১৯৩০ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩২ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি ৩/৪ বছর উত্তর ভারত ভ্রমণ করেন। দেওয়ান আজরফ ১৯২৫ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে হাসান রাজার দ্বিতয়ি পুত্র গনিউর রাজার কনিষ্ঠা কন্যা সাজিদুন্নেসা খাতুন চৌধুরীরানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দেওয়ান আজরফের স্ত্রী বিগত ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর ৬ পুত্র ও ২ কন্যা রেখে পরলোকগমন করেন। ১৯৩৬ সালে মুহাম্মদ নূরুল হক ও অন্যান্যদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় দেওয়ান আজরফ সিলেটে ‘কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ’ গঠন করেন। দেওয়ান একলিমুর রেজা এবং মুহাম্মদ নূরুল হক যথাক্রমে সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন। দেওয়ান আজরফ ১৯৪০-৪৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৩৭ সালে দেওয়ান মোঃ আজরফ সিলেট এমসি কলেজে অস্থায়ী প্রভাষক পদে নিযুক্তি পান। কিন্তু ৪/৫ দিন ক্লাস নেবার পরই তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু হলে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান এবং মুতাওয়াল্লিরূপে পৈতৃক ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ায় এমসি কলেজে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৯৪৬ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মুসরিম লীগে যোগ দেন এবং আসাম প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও দেওয়ান আব্দুল বাসেত তখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এ বছরই দেওয়ান মোঃ আজরফ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আসাম প্রাদেশিক আইন পরিষদের (আপার হাউজ) সদস্য নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বনিদ্বতায়।
১৯৪৬ সালে আসামে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হলে আসাম প্রদেশের গবহিরাগত মুসলমানদের উপর ভীষণ অত্যাচার করা হয়। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার বিরুদ্ধে প্রথমে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেস কর্তৃক প্রবর্তিত ১৪৪ ধারা অমান্য করার জন্য মুসলিম লীগ নেতা ও কর্মীগণকে আহবান করেন। দেওয়ান আব্দুল বাসেতকে সঙ্গে নিয়ে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তখন কামরূপ ও দড়ঙ্গ জেলার খাড়ুপুটিয়া, গোলন্দি, কালাইগাঁও, বড় পেটা প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনে নেতৃত্বদান করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। বড় পেটাতে আন্দোলন দমনে নিয়োজিত আসাম রাইফেলস থেকে তার প্রতি গুলীবর্ষণ করার সময়ে প ুরিশ সুপার শামসুদ্দীন হাজিারিয়া রাইফেলের নল আঁকড়ে ধরায় তিনি সে যাত্রায় রক্ষা পান। আন্দোলনের জন্য ভাসানীকে সর্বপ্রথম তেজপুরে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে একদল যুবক নেতা ও কর্মী আসামের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। এরূপ সক্রিয় আন্দোলনে শরীক হবার দরুন ১৭ মে আব্দুল বারী চৌধুরী, আব্দুল হাইসহ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে শিলচরের ফাটকবাজারে গ্রেফতার করা হয়। আজরফ সাহেব শিলচরে দশ মাস কারাদন্ড ভোগ করেন।
ভারত বিভাগের পরে সিলেটে এক গণভোটের আয়োজন করা হয়। দেওয়ান আজরফ গণভোটে দুর্গাপুর কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন। গণভোটের ফল অনুযায়ী সমগ্র সিলেট জেলা পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ববাংলায় আসার কথা। কিন্তু র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ করিমগঞ্জ মহকুমার ৩টি থানা যথা বদরপুর, বাতাবাড়ি ও পাথরকান্দি এবং করিমগঞ্জ থানার অর্ধৈক ভারত ইউনিয়নের কাছাড় জেলার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আসাম প্রাদেশিক মুসরিম লীগের পক্ষ থেকে বাউন্ডারি কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয এবং দেওয়ানি মোহাম্মদ আজরফকে তার সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। কলকাতায় তখন সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। স্মারকলিপি পেশ করার জন্য তারা যে গাড়িতে ওঠেন তার শিখ ড্রাইভার তাদেরকে নিয়ে বলি দেবার জন্য কালিঘাট অভিমুখে রওনা দেয়। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে ড্রাইভারকে তারা গসে চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করেন এবং ভেলভেডিয়ারে গিয়ে তারা কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসাম মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সদস্যগণ পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য বলে বিবেচিত হন। দেওয়ান মোঃ আজরফও এ সময় মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অীধবেশনে কুমিল্লার প্রখ্যাত আইনজীবী মিঃ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজিরি সঙ্গে বাংলাভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে গণ্য করার দাবি জানালে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিম উদ্দীন এবং গণপরিষদের স্বীকার মৌলভী তমিজ উদ্দিন খান তার বিরোধিতা করে যে বক্তব্য পেশ করেন তাতে পূর্ববাংলার সর্বত্র আগুন জ্বলে ওঠে। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) এক জনসভায় উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কায়েদে আজমের এ আকস্মিক ঘোষণায় কোনো প্রতিবাদ না হলেও তার দু’দিন পর (২৪ মার্চ) কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পুনরায় এ উক্তি করলে ডিগ্রি গ্রহণকারী কিছু ছাত্র তার প্রতিবাদ করেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তখন ছিলেন নওবেলাল নামক পত্রিকার সম্পাদক। সে পত্রিকায় গণপরিষদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যসহ জিন্নাহ সাহেবের ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। তার ফলে সিলেটের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী নওবেলাল তথা দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং মাহমুদ আলীর ওপর ক্ষেপে যায়। তারা উভয়ে মিলে তৎকালীন গোবিন্দ চরণ পার্কে যে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন, তাতে দেওয়ান অহিদুর রেজা ও মকসুদ আহমদ নামে একজন ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী হঠাৎ সেই সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে মকসুদ আহমদকে ধরে নিয়ে ভীষণ প্রহার করে। ট্রাক ভর্তি একদল লোক মানিকপীরের টিলাসংলগ্ন ‘নওবেলাল’ অফিসে উপস্থিত হয়ে উর্দু ভাষা সমর্থনকারীদের পক্ষে ¯েøাগান দিতে থাকে। এ সময় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বা মাহমুদ আলীর পক্ষে সিলেটে চলাফেরা করা ভীষণ সংকটজনক ছিল। প্রায়ই সংবাদ আসতো তারা যেকোন সময় আক্রান্ত হতে পারেন। তা সত্তে¡ও তারা বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যান।
১৯৪৮ সালের নবেম্বর মাসে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সুনামগঞ্জ কলেজের লজিকের প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে ভাইস প্রিন্সিপাল ও ৫৪ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মিছিল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বাসা থেকেই সর্বপ্রথম বের হতো এবং সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে আবার তাঁর বাসাতেই ফিরে আসতো।
১৯৫৪-তে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের নির্বাচনে পাকিস্তান খিলাফতে রববানী পার্টি তাঁকে প্রার্থী মনোনীত করে এবং প্রতিদ্বনিদ্বতার জন্য পীড়াপীড়ি করে। নিজ এলাকায় বিপুল জনপ্রিয়তা এবং মরহুম আবুল হাশিমের বার বার অনুরোধ সত্তে¡ও তিনি সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে সম্মত হননি। তা সত্তে¡ও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৫৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে সুনামগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তবে তৎকালীন গবর্নিং বডির সদস্য মোহাম্মদ মফিজ চৌধুরীর সুপারিশে তৎকালীন সিলেটের ডেপুটি কমিশনার আলী আহাদ সাহেব তা কার্যে পরিণত করেননি। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৯ সালে তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তখন থেকে আজীবন মজলিসের সুদিন-দুর্দিনে সভাপতি ছিলেন।
১৯৫৮ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ড. হাসান জামান ও তৎকালীন ফ্রাংকলিন পাবলিকেশনের পরিচালক (পরবর্তীকালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার) এটিএম আবদুল মতিন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান প্রমুখের সাথে মিলে দারুল উলুম ইসলামিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রামে রেজিস্ট্রীকৃত হয়। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আবুল হাশিমকে এর প্রথম পরিচালক নিয়োগ করেন। ইসলামিক একাডেমী ঢাকা নামে অভিহিত এ প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ নাম নিয়ে কাজ করে চলেছে।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ নরসিংদী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং ১৯৬৫-এর নবেম্বর থেকে ১৯৬৭-এর মে পর্যন্ত মতলব কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি এ জেড এম সামসুল আলমের সহযোগিতায় মালিবাগ আবুজর গিফারী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আবুজর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আজরফ ১৯৭৩ থেকে ‘৮৩ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্র বিভাগে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলর এবং ১৯৬২-৬৩-তে বাঙলা কলেজ গবর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে বিজাতীয় সংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠায়ও সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৫৬ সালে ভারতীয় দার্শনিক কংগ্রেসের তৎকালীন মাদ্রাজ প্রদেশে অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মনীষীদের প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্দোপাক কালচারাল কনফারেন্সে ‘নৈতিকতার শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬২-৬৩ সালে ইরাক সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে প্রথম মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দি সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফাউন্ডেশন কর্তৃক দার্শনিক কনফারেন্সের প্রবক্তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ঋধরঃয ধহফ জবধংড়হ রহ এৎবধঃ ঞৎধফরঃরড়হ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৮৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত ঈড়হপবঢ়ঃ ড়ভ ঐড়ষরহবংং রহ ঈযৎরংঃরধহরঃু ধহফ ওংষধস বিষয়ক সম্মেলনে ঐড়ষরহবংং রহ ওংষধস শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেন। সম্মেলনে ইসলাম সম্পর্কে কয়েকজন পাশ্চাত্য পন্ডিতের অশোভন উক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাকে বেশ অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও মোকাবিলা করতে হয়।
দেওয়ান মোঃ আজরফ ১৯৫৯ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের ধর্ম ও দর্শন শাখায় সভাপতিত্ব করেন। পরবর্তীকালে তিনি পাকিস্তান দার্শনিক কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ ও ১৯৭০ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির সহ-সভাপতি এবং ১৯৮৪ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি হজব্রত পালন করেন।
অল্প বয়স থেকেই দেওয়ান আজরফ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। ১৯৪০ সালে তার প্রথম গল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে ৬৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এখানে তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের একটি তালিকা প্রদত্ত হলো : (১) তমদ্দুনের বিকাশ, (২) সত্যের সৈনিক আবুজর, (৩) ইতিহাসের ধারা, (৪) নতুন সূর্য (গল্প গ্রন্থ), ৫. ব্যাকগ্রাউন্ড অব দি কালচার অব বেঙ্গল, (৬) জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম, (৭) ফিলোসফী অব হিস্টোরি, (৮) সাইন্স এন্ড রেভেলিউশন, (৯) ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে, (১০) আবুজর গিফারী (ইংরেজি), (১১) ইসলাম ও মানবতাবাদ, (১২) সন্ধানী দৃষ্টিতে ইসলাম, (১৩) দর্শনের নানা প্রসঙ্গ, (১৪) আজাদী আন্দোলনের তিন অধ্যায়, (১৫) আমাদের জাতীয়তাবাদ, (১৬) মরমী কবি হাসন রাজা, (১৭) ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি চরিত্র, (১৮) ইসলামিক মুভমেন্ট, (১৯) ধর্ম ও দর্শন, (২০) অতীত জীবনের স্মৃতি, (২১) নয়া জিন্দেগী (উপন্যাস), (২২) বিজ্ঞান ও দর্শন (৩ খন্ডে), (২৩), অতীত দিনের স্মৃতি (২৪) সিলেটে ইসলাম। ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ এখনও অপ্রকাশিত।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহিত্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক মুসলিম সংহতি পুরস্কার, নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮৪), ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৯), মহান একুশে পদক (১৯৯২), মাওলানা আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক (১৯৯৩), জালালাবাদ স্বর্ণপদক (১৯৯৪), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৯১), ভাসানী পুরস্কার (১৯৯৫), কবি মোজাম্মেল হক পুরস্কার (১৯৯১), শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর এবং স্বপ্লাবেশ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৯৩ সালে সরকার এই মহান ব্যক্তিত্বকে শিক্ষা, সমাজ সংস্কৃতি ও দর্শনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করেন।
১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। সুনামগঞ্জ জেলার পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট-গবেষক, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১