যে কারণে হেজু মিয়া, নিজামুদ্দিনরা সিলেটের সমাবেশে
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৪০:০৬,অপরাহ্ন ১৯ নভেম্বর ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিলেটে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশ আজ। অন্য বিভাগীয় সমাবেশগুলোর মতো সিলেটেও আগেভাগেই এসেছেন নেতাকর্মীরা। কেউ একদিন আগে, কেউবা ২ দিন আগেই এসেছেন। আগেভাগে আসা এসব মানুষ সমাবেশস্থলেই রাতযাপন করেন। মাঠেই রান্না করে খেয়েছেন। বাদ পড়েনি হোটেল কিংবা কমিউনিটি সেন্টারও। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত নগরীর আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ ও আশপাশের এলাকা। সমাবেশ ঘিরে পুরো শহরে সাজ সাজ রব। উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা। পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে সমাবেশস্থল।
নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে শোভা পাচ্ছে তোরণ। গতকাল বিকালে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসেন নেতাকর্মীরা। বিএনপি’র এই বিভাগীয় সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন কৃষক, জেলে, দিনমজুরসহ সাধারণ মানুষ। গত দুইদিনে এসব খেটে খাওয়া মানুষের উপস্থিতি ছিল বেশ লক্ষণীয়। সুনামগঞ্জের বাসিন্দা নিজামুদ্দিন। পেশায় একজন কৃষক। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নন।
হাওরে মাঠ ভর্তি পাকা ধান রেখে সিলেটে বিএনপি’র সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে সমাবেশস্থল আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে আসেন তিনি। মাঠেই রাতযাপন করেন। সরকারের ওপর রাগ আর ক্ষোভ থেকে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে নেতাকর্মীদের সঙ্গে আসেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সমাবেশে অনেকগুলো দাবি নিয়ে এসেছি। আমি আমার ভোটাধিকার ফিরে পেতে চাই। বিগত ১২/১৩ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত কোনো ভোট দিতে পারিনি। আমার ভোট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিয়ে দিয়েছে। আমরা ভোটের অধিকার চাই। ভোটের মাধ্যমে আমাদের যোগ্য সরকার নির্বাচিত করতে চাই। তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে কৃষকদের শান্তি নেই। সকল প্রকার কৃষি পণ্যের দাম চড়া। সার পাচ্ছি না। সব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে। খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা চলছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। কোথাও সুখ নেই। আমরা চাই জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার আসুক।
হবিগঞ্জের দিনমজুর হেজু মিয়া। অন্যের বাড়ি ও জমিতে কাজ করেন। ৭ জনের পরিবার। একাই উপার্জন করেন। সারাদিন খেটে যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কোনো সঞ্চয় নেই তার। অর্থের অভাবে বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। এরমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সবমিলিয়ে নানা সংকটে দিনযাপন করছেন তিনি। সমাবেশে আসার কারণ হিসেবে বলেন, বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সরকারে পরিবর্তন চায়। আমিও চাই। এই সরকারের আমলে দিনযাপন করা কষ্টকর হচ্ছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সারাদিন খেটে রোজগার নিয়ে বাজারে গিয়েও প্রয়োজন মেটে না। চাল কিনলে মাছ কিনতে পারি না। দেশের এমন পরিস্থিতিতে জনগণের সরকার চাই। যারা আমাদের দরিদ্র মানুষদের নিয়ে ভাববে। চাল ও তেলসহ নিত্যপণের দাম কমাবে। শ্রীমঙ্গলের বাবুল মিয়া। শিঙাড়া ও চা বিক্রি করে কোনো মতে সংসার চালান।
তিনিও সিলেট বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। বাবুল মিয়া বলেন, এলাকায় ছোট একটা চায়ের দোকান করি। কয়েক মাস লোকসানে আছি। ভোজ্য তেল, আটা ও জ্বালানির দাম বেড়ে গেলেও আমাদের আগের দামেই চা ও শিঙাড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। দেশের চলমান সংকটে মানুষ কিনে খেতেও চাচ্ছে না। আগে সারাদিনে ২/৩ হাজার টাকা বিক্রি করলেও এখন হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। এতে দিন দিন সংকটে পড়ে যাচ্ছি। সংসার চালাতে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। আমার ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে। তাদের জন্য দুধও কিনতে পারছি না। শিশুদের খাদ্যের ওপরও সিন্ডিকেট বাহিনীর হাত পড়েছে। সবমিলিয়ে আমার মতো লাখ লাখ মানুষ অভাব অনটনে আছে। অনেকেই লজ্জায় মুখ খুলছেন না। এরা সবাই আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করেছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিএনপি’র দাবি-দাওয়াগুলোর সঙ্গে আমাদের চাওয়ার মিল রয়েছে। এই কারণে বিএনপিকে সমর্থন জানাতে সমাবেশে এসেছি। সশরীরে সমাবেশে অংশ নিয়েছি।
জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশে যাননি গোলাপগঞ্জের আব্দুল হক। গতকাল সকালে নিজের তিন স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে সমাবেশে অংশ নেন। তিনি বলেন, দেশে নানা সংকট চলছে। এমন সংকট আগে দেখিনি। দিনে দিনে এই সংকট আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কতদিন আর ঘরে চুপ করে থাকা যায়। এখন সময় হয়েছে প্রতিবাদ জানানোর। এজন্য আমার তিন ছেলেকে নিয়ে সমাবেশের মাঠে উপস্থিত হয়েছি। আমার এলাকার হাজার হাজার কৃষক এই সমাবেশে এসেছেন। জকিগঞ্জের রাজমিস্ত্রি তারেক আহম্মদ বলেন, সমাবেশে এলাকার দরিদ্র মানুষরা বেশি অংশ নিয়েছেন। আমার সঙ্গে ১৯ জন এসেছেন। তারা সবাই দিনমজুর। একদিন কাজ না করলে ঘরে খাবার জুটে না। আমরা সবাই কোনো না কোনো ভাবে সংকটে রয়েছি। এই সরকারের দুর্নীতির কারণে সব কিছুর দাম বাড়তি। মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিনযাপন করছে। সিলেটে বিএনপি’র সমাবেশের সময় বাস বন্ধ থাকবে এটা আগেই জেনেছি। এজন্য আমরা বন্ধুরা এক হয়ে সমাবেশে যোগ দিয়েছি।
মাঠে বিএনপি নেতাদের তাঁবুতে অবস্থান করছি। আমরা চাই বিএনপি ক্ষমতায় আসুক। নতুন করে দেশে নির্বাচন হোক। এদিকে গতকাল রাত পর্যন্ত কয়েক হাজার দিনমজুর সিলেট বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। মাঠে থাকা নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন।
এদিকে গতকাল রাতেই সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। নেতাকর্মীদের চাপ বাড়লে মাঠ ভরে সড়কে অবস্থান নেন সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটের মানুষ। গতকাল সকাল থেকেই সিলেটে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যায়। নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন। কেউ কেউ মাঠে ও সড়কে শোডাউন করেন। দুপুরের পর মানুষের চাপ বাড়ে কয়েকগুণ। সিলেট নগরীর দোকানপাট গতকাল বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের চাপে সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। শহরের অলিগলিতে দেখা যায় বিএনপি’র বিভিন্ন অংঙ্গসংগঠনের মিছিল ও র্যালি। বিকালে কয়েক হাজার মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করেন তারা। এদিকে প্রস্তুত হয়েছে সমাবেশের মঞ্চ। সমাবেশস্থলসহ আশপাশে এলাকায় টানানো হয়েছে মাইক।
সমাবেশ বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা নেতারা বলছেন, আজ সিলেটে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হবে। এবারের সমাবেশ সিলেটে ইতিহাস হয়ে থাকবে। লাখ লাখ মানুষ আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে সমাবেত হবেন। যারা আসছেন তাদের একটাই দাবি- এই সরকারের পতন। সবাই তাদের মৌলিক অধিকারগুলো ফেরত চায়। বেঁচে থাকার জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ চায়। ভোটাধিকার ফেরত চায়। গতকাল দুপুরে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ পরিদর্শন করে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, বিএনপি’র সমাবেশ শনিবার। তবে মানুষের চাপ বেড়েছে গতকাল থেকেই। শুক্রবার রাতেই সিলেট নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হবে। বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বৃহস্পতিবার থেকেই মানুষ সমাবেশস্থলে চলে এসেছে। এই সমাবেশ জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মাঠ প্রস্তুত। সরজমিন দেখা যায়, সমাবেশে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মীর খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেছে প্রবাসী ও স্থানীয় বিএনপি নেতারা। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে চলছে রান্নার কাজ। নেতাকর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলছেন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ। মাঠের মধ্যে অন্তত ১৬টি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছেন তারা।
এসব ক্যাম্পে হাজার হাজার নেতাকর্মী রাত্রীযাপন করেন। তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন কেউ কেউ। মৌলভীবাজারের বড়লেখার ক্যাম্পে দেড় হাজার নেতাকর্মীর জন্য রান্না করছেন বাবুর্চি শাহে আলম। তিনি বলেন, সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের জন্য রান্না করেছি। মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি সভাপতি এম নাসের রহমানের উদ্যোগে ৭ হাজার নেতাকমীর মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। জুড়ি-বড়লেখার নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠুর উদ্যোগে রান্নার আয়োজন করা হয়। তিনবেলা খাবার রান্না করে সমাবেশে আসা মানুষদেরকে খাওয়ানো হচ্ছে।
হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি’র উদ্যোগেও প্রতিবেলা ৯০০ নেতাকর্মীকে খাবার দেয়া হয়েছে। মাঠের প্রবেশমুখে ‘ডা. জোবায়দা রহমান ফ্রি ফুড ক্যাম্প’ থেকে পানি, ফলমূল, রুটি, কলা ও খিঁচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র সাবেক সহ-ক্রিড়া বিষয়ক সম্পাদক সরফরাজ আহমেদ শরফু ও সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মামুনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি জুনেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রি ফুড ক্যাম্প উদ্বোধন করেন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। রাতে ৫ হাজার নেতাকর্মীর মাঝে খিঁচুড়ি বিতরণ করা হয়। সকালের নাস্তা হিসেবে রুটি কলা, কমলা ও পানি সরবরাহ করা হয়। সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্রি ক্যাম্প চালু থাকবে। সিলেটের সমাবেশস্থলে বিনামূল্যে ৫০ হাজার পানির বোতল বিতরণ করছেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পুত্রবধূ রেজিনা নাসের। এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন মৌলভীবাজার জেলা ও কলেজ ছাত্রদলের নেতারা। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি জনি আহমদ জানিয়েছেন, প্রয়াত অর্থমন্ত্রীর পুত্রবধূর নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের কাছে বিতরণ করতে ৫০ হাজার বোতল পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা সমাবেশের দিন বিকাল পর্যন্ত পানি বিতরণ করবো। এদিকে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘটের কারণে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতেই ধর্মঘট দিয়ে নেতাকর্মীদের বাধা দেয়া হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ সকল বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশেস্থলে আসছেন।
রাতেই সিলেটে পৌঁছেছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা। আজ সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সমাবেশে যোগ দিতে ইতিমধ্যে সিলেটে এসে পৌঁছেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিলেটের সমাবেশের সমন্বয়ক ড. আব্দুল মঈন খান, সহ-সভাপতি ডা. জাহিদ হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন। এ ছাড়া সিলেটের নেতাকর্মীদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন- চেয়াপরপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদীর লুনা, খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, ড. এনামুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি এম নাসের রহমান, কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছ, কেন্দ্রীয় সহ-ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া যুবদল সভাপতি সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না উপস্থিত থাকবেন।