রিসালাত-অপমাননা
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪৫:২৬,অপরাহ্ন ০৭ অক্টোবর ২০২২
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান:
ইসলাম বিরোধী মুশরিক, ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিকতা বিভিন্ন সময়ে মহানবী স. সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রসূলুল্লাহ স. সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইবনু খাতাল ও ইবনু আবী সারহ প্রমুখ। অধুনা এ ক্ষেত্রে সোমালীয় বংশোদ্ভূত নারী ‘আয়ান হারসি’ এবং ইরানের অধিবাসী ইহসান জাম প্রমুখের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। তাছাড়া তাদের মতো আরো অনেক ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এ হীন কাজে লিপ্ত রয়েছে। যখন-ই তারা নিজেদেরকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনেকরে এবং যে কোনো প্রতিশোধ ও প্রতিবাদ থেকে নিরাপদ মনে করে, তখন তারা এ ক্ষেত্রে চরম ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে। উল্লেখ্য যে, তাদের এ প্রগল্ভতা ও জঘন্য মিথ্যাচার বর্তমানে মিডিয়ার সুবাদে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। নিম্নে উদাহরণস্বরূপ ধৃষ্টতার একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো।
বাইরের কতিপয় লোক রসূলুল্লাহ স.-এর দেহ মোবারক তাঁর রাওয়া থেকে তুলে নেয়ার জন্য বারংবার মদীনায় গুপ্ত অভিযান পরিচালনা করেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল, এ অভিযানে সফলতার মাধ্যমে মুসলমানদের একটি তীর্থস্থানের মালিক হওয়ার স্বপ্নপূরণ করা। ইমাম আয-যাহাবী রহ. (১২৭৫-১৩৪৭ খ্রি.) ‘তারিখুল ইসলাম’ নামক গ্রন্থে বলেন, সালাহুদ্দীন আল-আইয়ুবী (১১৩৭-১১৯৩ খ্রি.) এমন একটি ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য প্রাণপণ শপথ নিলেন। তিনি মিসরের গভর্ণর সাইফুদ্দৌলা বিন মুনকিজ (১১৩২-১১৯৩ খ্রি.) কে লিখে পাঠালেন, তুমি লুলু আল-হাজিবকে প্রস্তুত করো। তিনি তার সাথে পরামর্শ করলেন। লুলু আল-হাজিব বললো, ঠিক আছে, তাদের সংখ্যা কতো? তিনি বললেন, তিন’শর ওপরে। তবে তারা সকলেই বীরযোদ্ধা। সে তাদের সংখ্যা অনুপাতে রশি নিলো। ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে কতিপয় ধর্মত্যাগী আরব ব্যক্তিও সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল। মদীনা থেকে তাদের দূরত্ব ছিল মাত্র একদিনের, এরূপ অবস্থায় লুলু তাদের পেয়ে গেল। তিনি আত্মসমর্পণের জন্য তাদেরকে সম্পদের অফার দিলেন, এতেই কাজ হলো। স্বর্ণের লোভে ধর্মত্যাগী আরব ব্যক্তিরা তার প্রস্তাবে সাড়া দিলো। বিদেশীরা একটি পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিলো। লুলু নয়জন লোকসহ পায়ে হেঁটে তাদের পর্যন্ত পৌছে গেলো। এর ফলে অভিশপ্তদের বাহুবল ভেঙে যায় আর লুলুর মনোবল বৃদ্ধি পায়। অত:পর সকলে লুলুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। লুলু তাদেরকে পাকড়াও করে রশিতে বেঁধে কায়রোতে নিয়ে আসেন। অবশেষে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
রসূলুল্লাহ স.-এর অবমাননার বিধান ঃ রসূলুল্লাহ স.-এর কোনো কথা, কাজ বা আচরণ সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য করা, তাঁকে গালমন্দ করা, তাঁকে কোনো খারাপ উপাধি ও নামে (যেমন- প্রতারক, মিথ্যুক, ভন্ড, সন্ত্রাসী প্রভৃতি) অভিহিত করা, তাঁর প্রদর্শিত দীন বা তাঁর কোনো বাণী নিয়ে উপহাস করা এবং তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কোনো তুলনা দেয়া বা ছবি নির্মাণ করা প্রভৃতি কুফরী কাজ। যে কোনো মুসলিম এরূপ কাজ করবে, সে মুরতাদ হয়ে যাবে। যদিও সে নিয়মিত সালাত ও সাওম ইত্যাদি আদায় করে থাকে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “মুনাফিকরা ভয় করে যে, তাদের বিষয়ে এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হবে, যা তাদের অন্তরের বিষয়গুলো জানিয়ে দেবে। বলো, তোমরা উপহাস করতে থাকো। নিশ্চয়ই আল্লাহ বের করবেন, তোমরা যা ভয় করছো। আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করো, অবশ্যই তারা বলবে, আমরা আলাপ ও খেল-তামাশাই করছিলাম। বলো, তাহলে তোমরা কি আল্লাহ এবং তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রসূলকে নিয়েই উপহাস করছিলো? তোমরা ছলনা করো না। এ কাজের মাধ্যমে তোমরা নিঃসন্দেহে তোমাদের ঈমান আনয়নের পর কুফরী করেছো।’’
এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তোমরা ঈমান আনয়নের পরে অবশ্যই কুফরী করেছো। এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে জানা যায়, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তাবুক যুদ্ধের সময় কোনো এক মজলিসে জনৈক ব্যক্তি (মুনাফিক) আলিমদের সম্পর্কে মন্তব্য করে যে, আমি আমাদের এই আলিমদের মতো এতটা ভোজনবিলাসী, এতটা মিথ্যাবাদী এবং শত্রুর মোকাবেলায় এতটা কাপুরুষ আর কাউকে দেখিনি। তখন ঐ মজলিসের একজন ব্যক্তি তার এ কটাক্ষ শুনে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি একজন মুনাফিক। আমি অবশ্যই তোমার এ বিষয়টি রসূলুল্লাহ স. কে অবহিত করবো। পরবর্তীতে রসূলুল্লাহ স. সংবাদটি জানলেন এবং তখনই উপর্যুক্ত আয়াতটি নাযিল হয়। বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহক ইবনে ‘উমর রা. বলেন, আমি লোকটিকে রসূলুল্লাহ স.-এর উষ্ট্রীয় কোমরের রশির সাথে বেঁধে পাথুরে ভূমিতে টানা হেঁচড়া করতে দেখতে পাই। এমন সময় সে আর্তনাদ করে বলছিল যে, ইয়া রসূলুল্লাহ! আমি তো এ কথাগুলো কেবল কৌতুক ও খেলাচ্ছলে বলেছিলাম (অন্তর থেকে বলিনি)। উত্তরে রসূলুল্লাহ স. বললেন, তাহলে কি তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর আয়াত ও রাসূল স. কে নিয়ে উপহাস করছো? এ হাদীস থেকে জানা যায়, যারা রসূলুল্লাহ স.-এর জীবদ্দশায় তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে কটূক্তি করেছিল, তারা শুধু ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান ছিল না; বরং নামধারী মুসলিমও ছিল। যারা কেবল নামায ও রোযা ইত্যাদি পালন করতো না; বরং রসূলুল্লাহ স.-এর সাথে তাবুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিল। রসূলুল্লাহ স. ও সাহাবীগণকে নিয়ে কটাক্ষ করার কারণে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল করে তাদেরকে কাফির বলে ঘোষণা করেন।
যে রসূলুল্লাহ স.-এর অবমাননা করে, সে নিঃসন্দেহে দুনিয়াতে আল্লাহর লানাতপ্রাপ্ত ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে অভিসম্পাদ করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।’’ তদুপরি তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর যে তোমাদের মধ্য থেকে তার দীন থেকে ফিরে যাবে, অত:পর কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, বস্তুত এদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারাই আগুনের অধিবাসী।
রসূলুল্লাহ স. কে অবমাননা করা এবং তাঁকে নিয়ে কোনো রূপ বিদ্রুপ করা তাঁকে মারাত্মক কষ্ট দেয়ার নামান্তর। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার জনৈক খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করলো এবং এরপর সে সূরা আল-বাকারা ও আলে ইমরান শিখলো। সে রসুলুল্লাহ সা.-এর পক্ষ থেকে চিঠিপত্র লেখালেখির কাজ আঞ্জাম দিতো। কিছুদিন পর সে পুনরায় স্বধর্মে ফিরে গেলো এবং বলতে লাগলো, মুহাম্মদ আমি যা লিখি তাই বলে। এর বাইরে সে আর কিছুই জানে না। এরপর সে মারা গেলো, তখন তার সাথীরা তাকে দাফন করলো, সকালে উঠে দেখলো, তার লাশ বাইরে পড়ে আছে, তখন খ্রিষ্টানরা বলতে লাগলো, মুহাম্মদের সাথীরা এই কাজ করেছে; কেননা সে তাদের ধর্ম ত্যাগ করেছিল। তখন তারা আরো গভীর করে কবর খনন করে তাকে আবার দাফন করলো, আবার সকালে উঠে দেখলো, তার লাশ বাইরে পড়ে আছে। তখন তারা এবারও বললো, এটা মুহাম্মদ এবং তার সাথীদের কাজ। কেননা সে তাদের ধর্ম ত্যাগ করে এসেছিল। তখন তারা আবার আরো গভীর করে কবর খনন করলো এবং তাকে দাফন করলো, আবার সকালে উঠে দেখলো, তার লাশ আবার বাইরে পড়ে আছে, তখন তারা বুঝতে সক্ষম হলো এটা কোনো মানুষের কাজ নয়। এরপর তারা তার লাশ বাইরেই পড়ে থাকতে দিলো।
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, যারা আল্লাহকে নিয়ে অথবা তাঁর আয়াত ও রসূল স. কে নিয়ে কটাক্ষ করে, তারা আর মুসলিম থাকে না; বরং তারা মুরতাদ ও কাফির হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, যারা ইসলাম ত্যাগ করে কাফির হয়ে যায় তাদের শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড, যদি সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাওবাহ করে ঈমানের পথে ফিরে না আসে। রসূলুল্লাহ স. বলেন, “যে ব্যক্তি তার দীন (ইসলামকে) পরিবর্তন করলো, তাকে তোমরা হত্যা করো। এ হাদীস থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, মুরতাদের শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। রসূলুল্লাহ স. নিজেও তাঁর জীবদ্দশায় মুরতাদদের ওপর এ শাস্তি কার্যকর করেছিলেন।
ইবনু খাতাল নামক জনৈক ব্যক্তি মকহ্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে সে মুরতাদ হয়ে আবার মক্কায় ফিরে আসে এবং রসূলুল্লাহ স.-কে নিয়ে নানা কটূক্তি করতে থাকে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু খাতালের দুই গায়িকা রসূলুল্লাহ স.-এর বিরুদ্ধে কুৎসামূলক গান গাইতো। এ কারণে রসূলুল্লাহ স. যখন মক্কা বিজয় করলেন, তখন অজন্যান্য কাফিরের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও ইবনু খাতাল ও তার মতো আরো কয়েকজন যারা একই ধরনের অপরাধী যেমন তার ঐ দুই দাসী, আব্দুল্লাহ ইবনু সাদ ইবন আবী র্সাহ, মিকয়াস ইবনু ছুবাবাহ আল-লাইসীকে ক্ষমা করেন নি। বরং তাদের মধ্যে একজন দাসী ব্যতীত সকলেই হত্যা করা হয়েছিল। দাসীটি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করত: মুক্তিলাভ করেন।
ইবনু খাতাল বাঁচার জন্য কাবাব গিলাফ ধরে ঝুলেছিল। রসূলুল্লাহ স.-কে বিষয়টি অবহিত করা হলো যে, ইবনু খাতাল বাঁচার জন্য কাবার গিলাফ ধরে ঝুলে আছে। রসূলুল্লাহ স. তাকে ঐ অবস্থায় হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। আনাস ইবন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ স. মক্কা বিজয়ের দিন মক্কায় প্রবেশ করে মাত্র মাথায় যে শিরস্ত্রাণ পরা ছিল তা খুললেন, এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে বললো, ইবনু খাতাল (বাঁচার জন্য) কাবার গিলাফ ধরে ঝুলে আছে। রসূলুল্লাহ স. বললেন, (ঐ অবস্থায়ই) তাকে হত্যা করো।
রসূলুল্লাহ স.-কে নিয়ে কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করার কারণে একজন সাহাবী তার নিজ দাসীকেও হত্যা করেন। রসূলুল্লাহ স. এ সংবাদ জেনে খুশি হন এবং উক্ত মহিলার রক্তকে মূল্যহীন বলে ঘোষণা করেন। ঘটনাটি হলো- ইবনু আব্বাসক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক অন্ধ ব্যক্তির একজন উম্মু ওয়ালাদ (এমন দাসী, যার গর্ভে মালিকের সন্তান জন্মগ্রহণ করে) ছিলো। ঐ দাসী রসূলুল্লাহ স.-কে নিয়ে অবিবেচকের মতো কটূক্তি করতো। অন্ধ ব্যক্তি তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন এবং নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতেন। কিস্তু দাসী কিছুতেই বিরত হতো না। এক রাতে দাসীটি রসূলুল্লাহ স. কে নিয়ে কটূক্তি ও গাল-মন্দ করতে লাগলো। তখন লোকটি একটি কোদাল দিয়ে তার পেটে আঘাত করলো এবং তাকে হত্যা করলো। এ অবস্থায় তার একটি সন্তান তার দু’পায়ের মাঝখানে পড়ে গেলো এবং রক্তে ভিজে গেলো। সকাল বেলা রসূলুল্লাহ স.-এর কাছে বিষয়টি জানানো হলে তিনি লোকদের জড়ো করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছে সে যেন অবশ্যই দাঁড়ায়। তার প্রতি আমারও একটি হক রয়েছে। তখন অন্ধ লোকটি কাঁপতে কাঁপতে মানুষের সারি ভেদ করে রসূলুল্লাহ স.-এর নিকট গিয়ে বসে পড়লো। অত:পর লোকটি বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ! ঐ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি আমিই। আমার দাসীটি আপনাকে গালি-গালাজ করতো এবং অযথা তর্কে লিপ্ত হতো। আমি তাকে বারণ করলেও সে নিবৃত্ত হতো না। তার থেকে আমার মুক্তোর মতো দু’টি ছেলে রয়েছে। তার সাথে আমার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু গত রাতে সে যখন আপনাকে গালমন্দ করতে লাগলো আমি তখন তাকে একটি কোদাল দিয়ে পেটে আঘাত করি। ফলে সে মৃত্যুবরণ করে। রসূলুল্লাহ স. উপস্থিত লোকদের বললেন, তোমরা সাক্ষী থাকো! তার রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করা হলো।
রসূলুল্লাহ স. মক্কা বিজয়ের পর কতিপয় কবিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। তারা রসূলুল্লাহ স. কে গাল-মন্দ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কবিতা আবৃত্তি করতো। তাদের বেশিরভাগ লোককেই হত্যা করা হয় এবং কিছু লোক পালিয়ে যায়। রসূলুল্লাহ স. তাদের ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন, তাদের যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই হত্যা করা হবে। এরূপ একজন কবি হলো কুরাইশ বংশের ইবনুয যিবা’রী। সে রসূলুল্লাহ স.-এর সাথে চরম শত্রুতা পোষণ করতো। সে ছিল একজন বড় মাপের কবি। সে রসূল স.-এর সমালোচনার সাথে সাথে মুসলিম কবি হাস্সান ইবন ছাবিত, কাব ইবন মালিক রা. প্রমুখের বিরুদ্ধেও সমালোচনামূলক কবিতা আবৃত্তি করতো। এ কারণে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয। মৃত্যুদন্ডাদেশ শুনে সে পালিয়ে নাজরান এলাকায় চলে যায়। এরপর সে ইসলাম গ্রহণ করে রসূলুল্লাহ স.-এর নিকট আগমন করে এবং নিজের তাওবা ও ওজর পেশ করে অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতাও আবৃত্তি করে। এতদসত্ত্বেও তার রক্ত বৈধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ তাকে হত্যা করার নির্দেশ বলবৎ রাখা হয়। অথচ সেদিন মক্কার সকল অপরাধীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কেবল সে এবং তার মতো যারা রসূলুল্লাহ স-এর নিন্দা ও কুৎসা রটনার মতো ন্যাক্কারজনক কাজে জড়িত ছিল তারা ব্যতিত।
স্মর্তব্য মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ স. মক্কার কাফির-মুশরিকদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। যদিও তারা বিলাল রা. কে উত্তপ্ত বালুর ওপর চিৎ করে শুইয়ে রেখে ওপরে পাথর চাপা দিয়ে চরম নির্যাতন করেছিল, আম্মার ইবন ইয়াসির রা. ও তার পরিবারকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিল, সুমাইয়া রা. কে বর্শা দিয়ে লজ্জাস্থানে আঘাত করে হত্যা করেছিলো। এমনকি স্বয়ং রসূলুল্লাহ স. কে হত্যার উদ্দেশ্যে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছিলো। সেসব চরম শত্রুকে ক্ষমা করা হলেও যারা রসূলুল্লাহ স. কে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে এবং ব্যঙ্গাত্মক কবিতা আবৃত্তি ও গান গেয়েছে তাদের ক্ষমা করা হয়নি; বরং রসূলুল্লাহ স. তাদের প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে বলেন যে, তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে, এমনকি কাবার গিলাফের নিচেও যদি পাওয়া যায়, তবুও তাদেরকে হত্যা করতে হবে। সে দিন রসূলুল্লাহ স. যাদের নাম ধরে হত্যার নির্দেশ জারি করেছিলেন তারা হলো: আবদুল্লাহ ইবন সাদ ইবন আবী র্সাহ, আবদুল্লাহ ইবন খাতাল, হুওয়াইরিছ ইবন নুকায়য, মিকয়াস ইবন ছুবাবাহ ও বনু তামীম ইবন গালিব গোত্রের একজন। এদের মধ্যে হুয়াইরিছ ইবন নুকায়যকে আলী রা. হত্যা করেন। ইসলামের সকল ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, রসূলুল্লাহ স.-কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিংবা গালি-গালাজহ করা অথবা কটূক্তি করার শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড।
সরকার রাষ্ট্রের পরিচালক ও অভিভাবক। সরকারের অন্যতম কাজ হলো শিষ্টের লালন এবং দুষ্টের দমন। অতএব, মুসলিম সরকারের দায়িত্ব হলো যারা রসূলের বিরুদ্ধে কটূক্তি করছে, তাদের সবাইকে এবং যারা তাদের সহযোগী তাদেরকে আইনের হাতে ন্যস্ত করা। কোনো ধরনের অজুহাত তৈরী করে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। কুরআন মাজীদে সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে, আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে।’’
যারা আল্লাহকে অথবা তাঁর রসূল স. কে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কিংবা তাঁকে গালমন্দ করে, ইসলামী শরীআহ আইন অনুযায়ী তারা নিঃসন্দেহে মুরতাদ ও কাফির। তাদের একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। এ ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের অকাট্য প্রমাণসহ দলমত নির্বিশেষে সকল ইমাম ঐকমত্য পোষণ করেন। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ স.-এর জীবদ্দশায় এই অপরাধে তাঁর নির্দেশক্রমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। মুসলিম উম্মাহর ঈমান রক্ষার স্বার্থে মুসলিম সরকারকে এ বিষয়ে সমুচিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর অপরাপর মুসলিম দেশ এ ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অধিকার যাতে ক্ষুণœ না হয়, সে বিষয়েও তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে।
লেখক : মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান,
পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১
(সুরমানিউজ’র মুক্তমত ও পাঠককলামে প্রকাশিত সব লেখা পাঠক কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত। এই সংক্রান্ত কোনো ধরনের দায় সুরমানিউজ বহন করবে না।)