কিশোর সমাজের বড় অন্তরায়
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৫৩:৫৯,অপরাহ্ন ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান:
কিশোর অপরাধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। সকল সমাজেই রয়েছে এর অনিবার্য উপস্থিতি। তবে প্রকৃতি ও মাত্রাগত দিক থেকে তা বিচিত্র। শিশু-কিশোররা মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাধ প্রবণতার দিকে ধাবিত হয়। সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির ইংরেজী হলো ঔাঁবহরষব উবষরহয়ঁবহপু। আর উবষরহয়ঁবহপু ল্যাটিন শব্দ উবষরহয়ঁবৎ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ঃড় ড়সরঃ বাদ দেয়া, বর্জন করা, উপেক্ষা করা ইত্যাদি। রোমানরা কোন ব্যক্তির উপর আরোপিত কর্ম অথবা কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা বুঝাতে উবষরহয়ঁবহপু শব্দটি ব্যবহার করত। কিশোর অপরাধ পরিভাষা আলোচনার পূর্বে শব্দ দু’টিকে পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করলে এর প্রতিপাদ্য বিষয় সহজেই অনুমেয় হবে। সাধারণত কিশোর বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তথা বাল্য ও যৌবনের মধ্যবর্তী বয়সের ছেলে-মেয়েদের বুঝায়।
অপরাধের আরবী আল-জারীমাহ। ইংরেজীতে একে পৎরসব, ড়ভভবহংব বরা হয়। আল-জারীমাহ শব্দটি একবচন, বহুবচনে আল-জারাইম, যা আল-জুরম থেকে উদ্ভুত। আল-জুরমু শব্দটির জীম অক্ষরে পেশ যোগে অর্থ পাপ, সীমালংঘন ইত্যাদি। ইসলামী আইনের পরিভাষায় অপরাধ বলতে শরী’আতের এমন আদেশ-নিষেধের লঙ্ঘনকে বুঝায়, যা করলে হদ্দ অথবা তা’যীর প্রযোজ্য হয়।
কিশোর অপরাধ প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে কিশোর বয়সে অবাঞ্ছিত ও সমাজ বিরোধী আচরণ সম্পাদন করাকেই বলা হয় কিশোর অপরাধ। মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানী ঈধাধহ বলেন, সমাজ কর্তৃক আকাক্সিক্ষত আচরণ প্রদর্শনে কিশোরদের ব্যর্থতাই কিশোর অপরাধ। আইনগত দিক থেকে কিশোর অপরাধ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে কর্তৃক আইন বিরুদ্ধ দÐনীয় কর্ম সম্পাদন করাকেই বুঝায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত দ্বিতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে কিশোর অপরাধের নির্ধারিত সংজ্ঞাটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
কিশোর অপরাধ বলতে কমিশন সে কাজকে বুঝায়, যে কাজ একজন বয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হলে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে কিশোর অপরাধের পরিচয়ে বলা যায় যে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে কর্তৃক সংঘটিত দেশীয় আইন, সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থী কর্মকান্ডকেই কিশোর অপরাধ বলে।
বংশগতি বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্য কিশোর অপরাধের অন্যতম একটি কারণ। শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে যে দৈহিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য লাভ করে সেটিই তার বংশগতি। জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ব্যক্তির মন-মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-ব্যবহার, চিন্তাধারা প্রভৃতি বিষয় বংশগতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক ত্রæটি শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ ও অপরাধমূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ে। জন্মগত শারীরিক ও মানসিক ত্রæটিগুলো যেমন মাথার খুলি স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট বা বড়, গাঢ় ও ঘন ভ্রæ, চেপ্টা নাক, প্রশস্ত হাতের তালু, প্রশস্ত কান, ঘন চুল, লম্বা বাহু, চোখ বসা, হাত-পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুল, সংকীর্ণ কপাল, অসামঞ্জস্য দাঁত, দুর্বল চিত্ত, ক্ষীণ বুদ্ধি, আত্ম-নিয়ন্ত্রণহীন, অসৎ প্রকৃতি ও বেদনার প্রতি অতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. ঐবধষু শিকাগো শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিশোর অপরাধীদের ৩১% এর দৈহিক বিকাশ অস্বাভাবিক। এছাড়াও ইতালিতে সা¤প্রতিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক অক্ষমতা দূর করা গেলে কিশোরদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।
কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবসময় পরিবারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। পরিবারের সূচনা হয় স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে। আর পারিবারিক পরিমন্ডলে সন্তানের জন্ম হয় এবং বিকাশ লাভ করে। সন্তানের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশের জন্য পিতামাতার মধ্যে স¤প্রীতিময় দাম্পত্য জীবন একান্ত অপরিহার্য। পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য ও কলহ বিবাদ থাকলে সন্তানের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা পরিণামে শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। পরিবারের অন্যান্য সদস্য যদি অনৈতিক বা সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকে তাহলে পরিবারে কিশোর অপরাধ সমস্যা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। তেমনিভাবে ভগ্ন পরিবার ও কিশোর অপরাধের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেননা ভগ্ন পরিবারে সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরিবারের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয় দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শিশু-কিশোররা ত্রæটিপূর্ণ আচার-আচরণ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আফসার উদ্দিন কর্তৃক পরিচালিত অনুসন্ধানটি উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে দেখা যায় যে, কিশোর অপরাধীদের শতকরা ৩৭ ভাগ ভগ্ন পরিবার থেকে আগত। অন্যদিকে বাসস্থানের অনুপযুক্ত পরিবেশ কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যেমন নিম্নমানের গৃহায়ণ ও বস্তি এলাকার পরিবেশে শিশু-কিশোররা জীবনের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিচ্যুত আচরণ দ্বারা তারা তাদের আশা আকাক্সক্ষা ও চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হয়। এভাবেই বাসস্থানের খারাপ পরিবেশ কিশোর-কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়।
কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে পরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং পাড়া-প্রতিবেশী. খেলার সাথী ও সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এধরনের সম্পর্কের মাধ্যমে শিশু-কিশোররা অত্যন্ত সহজে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, যা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে তা করতে পারে না। সুতরাং সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে কেউ অসৎ প্রকৃতির বা অপরাধপ্রবণ থাকলে তাদের প্রভাবে অনেক সময় কিশোর-কিশোরীরা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে।
কিশোর অপরাধের সাথে ভৌগোলিক পরিবেশের এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যেমন মরু এবং গ্রীষ্ম প্রধান এলাকার মানুষ সাধারণত রুক্ষ স্বভাবের ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ ছাড়াও অরণ্যে ঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকা, চরাঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকার কিশোর-কিশোরীরা তুলনামূলক অপরাধপ্রবণ হয়। অপরাধবিজ্ঞানী ডেক্সটারের মতানুযায়ী, বায়ূর চাপের সাথে মানুষের স্নায়ুবিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এবং তার ফলে ব্যারোমিটারে পারদের উঠা-নামার সাথে অপরাধ প্রবণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে জলবায়ূর প্রভাবজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার অনেক শিশু-কিশোর পারিবারিক পরিবেশের বাইরে উদ্বাস্তু ও ভাসমান হিসেবে বেড়ে উঠে। বিধায় জীবনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত এসব কিশোরের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, বøগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যৌন রসে সিক্ত সিনেমা, বিজ্ঞাপন চিত্র, ফ্যাশন শো-এর নামে টেলিভিশনে প্রদর্শিত যৌন আবেদনময়ী অনুষ্ঠানমালা আবেগপ্রবণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও মানসিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিপথগামী করে তোলে। এছাড়া টেলিভিশনে প্রদর্শিত দুঃসাহসিক অভিযাত্রার সিরিয়াল, ভায়োলেন্স এবং অপরাধের নানা কলা-কৌশল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিশোর-কিশোরীরা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। অধুনা সাইবার ওয়ার্ল্ডের সাথে যুক্ত আবেগ প্রবণ কিশোর-কিশোরীরা আশঙ্কাজনক হারে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কিশোর অপরাধ একটি জটিল ও মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে কিশোর অপরাধ প্রবণতার কারণগুলো হলো, শিশু-কিশোররা বংশগতির মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে অপরাধ প্রবণতা লাভ করে না, যেমন কিছু রোগ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। কিশোর অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকগুলো কারণ সম্পৃক্ত। যেমন পারিবারিক ভাঙন, গৃহের খারাপ পরিবেশ, অসৎ সঙ্গ, পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা, গণমাধ্যমে কুপ্রভাব ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ বা মনের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা ইত্যাদি। তবে প্রবৃত্তির অনুসরণে মনের চাহিদানুযায়ী যা ইচ্ছা তা করাই কিশোর অপরাধের মূল কারণ। কেননা মনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাল-মন্দ প্রতিটি কর্ম সম্পাদিত হয়। আর অন্যান্য কারণগুলো মনকে প্রভাবিত করে। মানুষের মনের সঠিকতার উপর নির্ভর করে আচরণের সঠিকতা। মন যখন ঈমান, যথার্থ ‘ইলম, ‘ইবাদত ও নৈতিক গুণাবলি দ্বারা সুশোভিত হবে, তখন ব্যক্তির সমস্ত কাজকর্ম সুন্দর হবে। সন্তানের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করতে পারে তার পরিবার। কেননা শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ তার পিতা-মাতা ও অভিভাবকের সুশিক্ষা, সচ্চরিত্র এবং লালন-পালন সংক্রান্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল।