রক্তদানের ইতিহাস এবং আজকের প্রেক্ষাপট
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:২৭:২৫,অপরাহ্ন ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
রক্তদান হল কোন প্রাপ্তবয়ষ্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া। সাধারণত কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তি রক্তের স্বল্পতাজনিত কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়াকে রক্তদান বলে। ইংরেজিতে তাকে ইষড়ড়ফ উড়হধঃরড়হ এবং আরবীতে ‘‘নাক্ল আদ্-দাম’’ ও ‘‘তাবাররু বিদ দাম’’ বলা হয়। চিকিৎসকরা নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। নিরাপদ রক্ত বলতে যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, কেমিক্যাল ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদান বা যে কোন জীবাণুমুক্ত রক্তকে বোঝায়। একমাত্র স্বেচ্ছায় সুস্থ রক্তদাতার মাধ্যমে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে দাতার একটি সংক্ষিপ্ত শারীরিক পরীক্ষা ও চিকিৎসার ইতিহাস গ্রহণ করা হয়। এরপর নমুনা সংগ্রহ করে ‘বøাডস্ক্রিনিং’ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে নিশ্চিত করা হয়। রক্তের মাধ্যমে ছড়ানো রোগগুলো এ পরীক্ষার অন্তর্ভূক্ত। এ ক্ষেত্রে রক্তদাতা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এইডস্, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ইত্যাদি পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে যায়। মূলত রক্তদাতার সুস্থতা ও দানের উপযোগিতা এবং গ্রহীতার জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকিমুক্তির নিমিত্ত এসব পরীক্ষা করা হয়। গৃহীত রক্তের পরিমাণ ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত একজন দাতা থেকে একবার সর্বোচ্চ পাঁচশত মিলিলিটার রক্ত নেয়া হয়। সংগৃহীত রক্ত পরিসঞ্চালন বা অংশীকরণের মাধ্যমে ঔষধে পরিণত করে গ্রহীতার দেহে প্রবেশ করানো হয়।
সর্বপ্রথম ১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহের বিষয়ে জানতে পারে। স্যার ক্রিস্টোফার রেন ১৬৫৭ সালে ডা. উইলিয়াম হার্ভে আবি®কৃত যন্ত্র ব্যবহার করে জন্তুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান। ডা. রিচার্ড লোয়ার ১৬৬৬ সনে সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। অবশ্য এর পরে পশুর দেহ থেকে মানবদেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের হাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ। ফলে ১৬৭৮ সনে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপ নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। ডা. জেমস বøান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ১৮১৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্যে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন। ১৯০১ সনে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার মানুষের রক্তের প্রধানত ৪টি গ্রæপ এ, ও, বি, এবং এবি. সনাক্ত করেন। ১৯১৪-১৯১৮ সনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এ সময়টায় যুদ্ধাহত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। তখনই মানুষ রক্তদাতার শরীর থেকে বের করে সোডিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে জমাট বাঁধা থেকে রক্ষা করা এবং ফ্রিজে সংরক্ষণ করা আবিষ্কার করে। প্রথমবারের মতো ১৯১৬ সনে সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করান হয়। এই ধারণা থেকেই একজন আমেরিকান মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম বøাড ব্যাংকের সূচনা করেন। তারপর ১৯২১ সনে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে বৃটিশ রেডক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত সূচিত হয়। এর ফলশ্রæতিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় উপমহাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান শুরু হয়। ইম্পিরিয়াল সেরোলজিস্টরা ১৯২৫ সনে কোনো ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া একজন রক্তদাতার দেহ থেকে একটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত করে রক্তগ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা নিয়ে কলকাতার ট্রপিকেল মেডিসিন স্কুলে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র শুরু করে। ১৯৩৯ সনে ভারতের রেডক্রস সোসাইটি একটি বøাড ব্যাংক কমিটি গঠন করে। এই কমিটি যন্ত্রপাতি দিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটিকে সহায়তা করে এবং রক্তদাতাদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করে। ফলে ফ্লাস্কে করে রক্ত সংগ্রহ করে তা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। মূলত চল্লিশের দশকে মেট্রোপলিটন শহরে এবং পঞ্চাশের দশকে জেলা শহরগুলোতে বøাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব বøাড ব্যাংকগুলোই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বলে অনেক বেসরকারি বøাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথমবারের মতো তিন দিনব্যাপী ন্যাশনাল সেমিনার এন্ড ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তখন থেকে ‘গিফট অফ বøাড’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সকল প্রকার রক্তের কেনাবেচা বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে স্টেট বøাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল গঠনের জন্যে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১০ই জুন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সূচনা করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রের উদ্যোগে সন্ধানী নামে প্রথম রক্তদান সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৮১ সনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ১৯৮২ সালে অরকা, ১৯৯৬ সনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ১৯৯৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন ‘বাঁধন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ ধরেই ৫ মে ২০০৫ সালে বøাড-ফ্রেন্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নতুন মাত্রা যোগ করে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহের অভাবে পেশাদার রক্ত বিক্রেতার দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি বা এইডসের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দূষিত রক্তের পরিসঞ্চালন থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষার জন্য নিরাপদ ও সুস্থরক্তের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেছে।
বাংলাদেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সরকার ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন, ২০০২’ শিরোনামে ২০০২ সনের ১২ নং আইন পাশ করে। আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং রোগীর দেহে পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রণীত আইন। এই আইন ২০০২ সনের ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই আইনে রক্ত বলতে পরিপূর্ণ মানব রক্ত এবং রক্তদানকে একটি সেবামূলক কাজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইন অনুসারে অনুমোদিত ব্যক্তি নিরীক্ষিত রক্ত অনুমোদিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও পরিসঞ্চালন করতে পারবে। ডাক্তার কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন চিকিৎসা প্রদানকালে প্রদেয় রোগীর বা রক্ত গ্রহীতার রক্তের সঠিক চাহিদা, রক্তের উপাদানের প্রকৃতি, রোগী বা রক্ত গ্রহীতার বিদ্যমান শারীরিক অবস্থা এবং রক্ত পরিসঞ্চালনের ধরন বা পদ্ধতি ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এমবিবিএস বা সমমানের ডিগ্রিধারী এবং রক্ত পরিসঞ্চালন মেডিসিন বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিবিএসএন্ডটি, এমটিএম, এমডি, পিএইডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ ‘রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ’ বলে বিবেচিত হবেন। এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবেন এবং তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেবেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একুশ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কাউন্সিল’ রয়েছে। এতদসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্ভূত আনুষঙ্গিক বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এই কাউন্সিলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ‘হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস অর্থাৎ এইচআইভি’, ‘হেপাটাইটিস বি ভাইরাস’, ‘হেপাটাইটিস সি ভাইরাস’, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসসহ সর্বপ্রকার রক্ত বাহিত রোগ থেকে মানব দেহকে রক্ষার জন্য; নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিসঞ্চালনের পদ্ধতি নির্ধারণ; রক্তদাতাদেরকে স্বেচ্ছায় রক্তদান, স্বজনকে রক্তদান এবং রক্তের বিনিময়ে রক্তদানকে উৎসাহিত করা; পেশাদার রক্তদাতাদেরকে রক্তদানে পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব উক্ত কাউন্সিলের। এই কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত; রক্তদাতাদের পরিসংখ্যান সংরক্ষিত ও সরকারী হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে। লাইসেন্স ব্যতীত বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা; ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রদান; অননুমোদিত পদ্ধতিতে রক্ত পরিসঞ্চালন; বিনষ্টযোগ্য উপকরণ বিনষ্ট না করা এবং তা পুনরায় ব্যবহার করা; অনিরীক্ষিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা; অননুমোদিত উপায়ে রক্ত, রক্তের উপাদান ও রক্তজাত সামগ্রী সংগ্রহ, উৎপাদন ও বিতরণ করা’ অননুমোদিত ব্যক্তি কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন করা; রক্তদাতার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা এবং অতিরিক্ত সেবা ফিস আদায় করা এই আইন অনুসারে দÐনীয় অপরাধ। উল্লিখিত অপরাধসমূহের যে কোন একটি বা একাধিক অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারান্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সশ্রম কারাদÐ অথবা জরিমানা অথবা উভয় দÐে দÐিত হবে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত সকল অপরাধ অআমলযোগ্য (ঘড়হ-পড়মহরুধনষব), জামিনযোগ্য, আপোষযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মামলা দায়ের করতে হবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এই আইন অনুসারে কৃত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করতে পারবেন (ক) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং তার অবর্তমানে মহা-পরিচালকের দায়িত্ব পালনরত কোন কর্মকর্তা অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা এবং (খ) ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি। এরা ছাড়া আর কেউ এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করতে পারবে না। অভিযোগ দায়ের করতে হবে লিখিতভাবে। এছাড়া নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন ২০০২-এর আলোকে ২০০৮ সালে প্রণীত হয় রক্তদান বিধিমালা। এতে সরকার অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রক্তবাহিত রোগ নির্ণয়, রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ত সংরক্ষণ এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট, রক্তের ব্যাগ ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কোন বিশেষ দিন বা ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্তদান পরিলক্ষিত হয়। এতে নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী রক্ত সরবরাহ হয়। অনেক সময় উদ্বৃত্ত রক্ত নষ্টও হয়ে যায়। অন্যদিকে সারা বছর দেশে যে পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন তাও পূরণ হয় না। ফলে শুধু রক্তের অভাবে অসংখ্য মানুষ মারাও যায়। এ ক্ষেত্রে রক্তদাতারা নিয়মিত ‘বøাডব্যাংকে’ রক্তদান করলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। রক্ত বেশীদিন সংরক্ষণ করা যায় না। তাছাড়া রক্ত নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বাইরে কয়েক ঘন্টা রাখা হলে রোগীর শরীরে পরিসঞ্চালনের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই বøাডব্যাংকে রক্তাদাতাদের তালিকা সংরক্ষণ করা হলে প্রয়োজনের মুহুর্তে রক্ত সরবরাহ করা যায়।
নিজের আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনে রক্ত দেয়ার মানসিকতা বৃদ্ধি পেলেও তা যথেষ্ট নয়। অথচ প্রত্যেক রোগীই তার আত্মীয়-স্বজন থেকে প্রয়োজনীয় মুহুর্তে রক্তের যোগান পেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি বদান্যতা, কৃপা, উদারতা, সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ের ইসলামী বিধান উপস্থাপনের মাধ্যমে রক্তদানে আরও উৎসাহিত করা যেতে পারে।
দেশে পেশাদার রক্তদাতাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। এদের রক্ত ব্যবহারে রোগী সাময়িকভাবে সুস্থ হলেও দীর্ঘমেয়াদে রক্তবাহিত জটিল কোন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে নির্দিষ্ট পরীক্ষা করার ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করতে হবে। নিরাপদ রক্তদানের ব্যাপারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সর্ব সাধারণ পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহের উদ্দেশ্যে সন্ধানী, রেডক্রিসেন্ট, বাঁধন প্রভৃতি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিতকরণে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিয়ের আগে ছেলে ও মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এতে তাদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ পুরো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রহিত হবে। বিয়ের পর শারীরিক সম্পর্ক ও রক্তের মাধ্যমে এইচআইভি/ এইডস, হেপাটাইটিস বি ও সি, ডায়াবেটিস, লিউকোমিয়া, সিজোফ্রেমিয়া ইত্যাদি বেশ কিছু সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ হতে পারে। সেক্সুয়্যাল প্রবলেম যেমন স্বামী-স্ত্রীর নরমাল প্রোডাক্টিভিটিও নষ্ট হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া নামের এই রেগাটি বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচুর। বাবা-মা দুইজনই এই রোগের বাহক হলে সন্তান জন্মের পরই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং সাধারণত একুশ বছরের বেশি বাঁচে না। এতসব ঝামেলা এড়ানোর জন্যই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
রক্তের অপর নাম জীবনপ্রবাহ। ফলে রক্তদান এ অর্থে জীবনদান। তাই রক্তদান আত্মার বাঁধন তৈরি করে। রক্তদান নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের প্রতি ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় প্রকার স্বীকৃতি রয়েছে। নিয়মিত রক্তদানে দাতার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। অন্যদিকে প্রতিদিন বিভিন্ন কারণে প্রয়োজনীয় হাজার হাজার ব্যাগ রক্তের চাহিদা পূরণ করে গ্রহীতাদের জীবনও রক্ষা করা সম্ভব হয়। নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে রক্তদানের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রক্তদান কর্মসূচিতে মানুষ রক্ত দিতেভিড় করে। বিশেষ করে এতে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক। বেশিরভাগ রক্তদাতাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। অনেক রক্তদাতা কেবল পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে। অনেকে সমাজ সেবামূলক কাজ হিসেবে রক্তদান করেন। কেউ কেউ তার ভবিষ্যত প্রয়োজনে রক্ত পেতে বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করে নিয়মানুযায়ী রক্তদান করেন। তবে জনগণকে আরও সচেতন করতে পারলে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।