সিলেটে যে খেলা দেখালেন নাসির
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০৮:২৭,অপরাহ্ন ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
অধ্যক্ষ এনামুল হক সর্দারকে নিয়ে কানাঘুষা ছিল সিলেটে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নাসির উদ্দিন খানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও ছিল তার নাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সরে দাঁড়ালেন তিনি। মনোনয়নপত্র জমা দিলেন না। ফলে একক প্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। রাজনৈতিক জীবনে এবার প্রথমই নাসির কোনো নির্বাচনে অংশ নিলেন। এবং সেখানেই তিনি বাজিমাত করলেন। নিজ দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা বিরোধীরাও পেলেন নাসিরকে নিয়ে ভোটের মাঠে খেলার সুযোগ। সিলেট জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার দলের ভেতরে মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন নাসির উদ্দিন খান।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী মনোনয়ন চাইলেই পেতেন- এমন ধারণা ছিল নেতাকর্মীদের। এরপরও নাসিরকেই ছাড় দিলেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। সিলেট-২ আসনে নৌকা নিয়ে লড়াইয়ের অপেক্ষায় থাকলেন তিনি। ফলে নাসিরের জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি সহজ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বোর্ড নাসির উদ্দিন খানকে সমর্থন দেয়। এটি হচ্ছে নাসিরের প্রাথমিক বিজয়। এরপর জেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন নাসির। তার সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অধ্যক্ষ এনামুল হক সর্দার। গতবার তিনি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এডভোকেট লুৎফুর রহমানের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। একই এলাকায় বাড়ি হলেও এনামুল হক সর্দার লুৎফুর রহমানের সঙ্গে ভোটের মাঠে ছাড় দেননি। এবার নির্বাচনের শুরু থেকেই তাকে নিয়ে জল্পনা ছিল। প্রার্থী হতে পারেন এনামুল হক চৌধুরী- এমন আভাসও দেন তার ঘনিষ্ঠজনরা। তারা জানিয়েছেন- গত মঙ্গলবার তার পক্ষে সিলেট জেলা নির্বাচনী কার্যালয় থেকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন সংগ্রহ করা হয়। তবে প্রার্থী হওয়া এবার কঠিন ছিল এনামুল হক সর্দারের জন্য। তিনি পেশাজীবী নেতা হলেও সরাসরি আওয়ামী লীগ ছিল তার প্রতিপক্ষ। আর এতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর জন্য একমাত্র বাধাও ছিলেন তিনি। ফলে তার ওপর অঘোষিত চাপ ছিল। এ নিয়ে সিলেটে গত এক সপ্তাহ ধরে নাটকীয়তা কম হয়নি।
সর্বশেষ সমঝোতায় এগিয়ে আসেন সিলেট-৪ আসনের এমপি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। অগ্রজ ইমরান আহমদকেই মানেন এনামুল হক সর্দার। অনেক দিনের সম্পর্ক। ভালো-মন্দ সব সময় তারা একসঙ্গে রয়েছেন। ফলে এনামুল হক সর্দারকে নির্বাচন থেকে সরাতে মন্ত্রীই নেন সমঝোতার উদ্যোগ। এটি সফল হয়েছে। এনামুল হক সর্দারের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন- গত বুধবার রাতে মন্ত্রীর তরফ থেকে আসে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত। এবং সেটি মেনেও নেন এনামুল সর্দার। তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও শেষ দিনে জমা দেননি। এ পদে একক প্রার্থী হিসেবে দুপুরে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। অগ্রজ নেতা, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়েই মনোনয়নপত্র জমা দেন। আর বেরিয়ে এসে তিনি সিলেটবাসীর দোয়া চেয়েছেন। অধ্যক্ষ এনামুল হক সর্দার মনোনয়নপত্র জমা না দেয়া প্রসঙ্গে গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘গত বছর আমি যেকোনো কারণেই হোক নির্বাচন করেছি। বর্ষীয়ান রাজনীতিক এডভোকেট লুৎফুর রহমানের সঙ্গে নির্বাচন করে ভালো ভোটও পেয়েছি।
কিন্তু পরাজিত হওয়ার কারণে যারা আমাকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। এবার ভোটাররা আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন। তারা আমার পক্ষে কাজ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এর বাইরে প্রচুর মানুষের সমর্থন ছিল। সবাই চেয়েছিলেন প্রার্থী হতে।’ তিনি বলেন- ‘ব্যক্তিগত কারণে আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। ভোটারদের আবদার রক্ষা করতে পারলাম না, এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। নির্বাচন করে যদি পাস হতাশ তাহলে আরও বৃহৎ পরিমণ্ডলে কাজ করার সুযোগ পেতাম। এটা আমি মিস করলাম। এটা আমার জন্য কষ্টেরও।’ একক প্রার্থী নাসির উদ্দিন খান। এটি সিলেটে তার রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার আরও একটি প্রক্রিয়া। সিলেট আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারক মহলের একজন নাসির। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ ফরম্যাটেও তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিন বছর আগে যখন সিলেট আওয়ামী লীগকে নতুন ফরম্যাটে প্রস্তুত করা হয় তখন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মেসেজও ছিল এটি। কেন্দ্রীয় নেতারা সিলেট আওয়ামী লীগে ঐক্যবদ্ধতা চান। আর সেটি এবার হয়েছে। ভেতরে ভেতরে প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু দ্বন্দ্ব তেমন প্রকাশ্যে আসছে না।
এক নেতা আরেক নেতাকে ছাড় দেয়ারও মনোভাব তৈরি হয়েছে। শফিকুর রহমান চৌধুরী দেখালেন সেই দৃষ্টান্ত। মহানগর নেতারাও নাসিরের পক্ষে একাট্টা ছিলেন। তারা এর বাইরে আর কাউকে চাননি। ফলে কেন্দ্রের কাছে নাসিরই ছিলেন শক্তিশালী প্রার্থী। আর সে কারণেই কেন্দ্র নাসিরকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড। ইতিমধ্যে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার চিঠিও পেয়েছেন তিনি। করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে বৈঠক। সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন। জেলা পরিষদকে কেন্দ্র করেই বিগত এক দশক ধরে আবর্তিত হচ্ছে সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এরআগে এক প্রশাসক ও এক চেয়ারম্যান ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এবার সেই চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। সেখানেই নাসিরের সার্থকতা। কেন্দ্রের কাছেও গেল নতুন বার্তা। ভোটের লড়াইয়ের আগে নির্বাচনী খেলায় নাসির সেরা- সেই ম্যাসেজটিও পেলো কেন্দ্র। দলীয় নেতারা জানিয়েছেন- দায়িত্ব বেড়ে গেল নাসিরের। এতদিন দলের জন্য কাজ করেছেন। এবার সিলেটের উন্নয়নের জন্য তাকে কাজ করতে হবে। আর সেটি তাকে করতে হবে সমতার ভিত্তিতেই। এই কাজটি হবে তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জ।