আইনের আশ্রয়ে আইন অবমাননা
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৫২:২৬,অপরাহ্ন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
আইন সভ্যতার প্রতীক। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে মানুষ সভ্য এবং প্রথম দিন থেকেই আইনের অনুগত। প্রথমে যে দুজন মানুষ পৃথিবীতে আসেন তারা তাদের সৃষ্টিকর্তা এবং প্রেরণকারী আল্লাহর আইনের অনুগত থাকেন। সমাজ, সভ্যতা, আইন তিনটি তাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজ সভ্যতা তারা তৈরি করেন, আইন তাদেরকে দেয়া হয়। বরং বলা যায় আইনের মাধ্যমে তারা সমাজ ও সভ্যতাকে পরিশীলিত ও নিয়ন্ত্রিত করেন। প্রথমে মানুষ তথাকথিত বন্য ও অসভ্য ছিলেন না। বরং তারা মাথা ঘামিয়ে চিন্তা ভাবনা করে প্রত্যেকটি কাজ করতেন। তারা আল্লাহর আইনের পূর্ণ অনুগত ছিলেন। আল্লাহর আইনের অমর্যাদা করে প্রথম যে ভুলটি তারা করেন সেজন্য তারা অনুতপ্ত হন এবং এ থেকে কিভাবে আইন মেনে চলতে হয় সে শিক্ষা লাভ করেন। তাঁরা বলেন, ‘হে আমাদের রব! আমরা আইন ভঙ্গ করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আর এই আইন ভঙ্গ করার যে স্বাধীন ক্ষমতা আমাদের আছে যদি তুমি তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের না বাঁচাও তাহলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (আল-আরাফ ঃ ২৩)
এভাবে পৃথিবীতে মানুষের সত্তা তার রবের সহযোগিতায় আইনের যথাযথ আনুগত্য করে এগিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়। পদে পদে মানুষ ভুল করে ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। পৃথিবীতে মানুষের জীবন হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। একজন মানুষের জীবন একশো বছর বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি। কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুর ধারাবাহিক সিলসিলা এই একশো বছরকে সুদীর্ঘকালে পরিণত করেছে। কালের আঙিনায় একজনের থেকে আরেক জন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেই চলেছে। তাই আজকের একজন মানুষের জীবন কেবল একজন মানুষের নয় বরং সমগ্র মানবতার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট। আর মানুষের এই অভিজ্ঞতা আইনের শৃংখল পরিবেষ্টিত। মানুষ পদে পদে আইন তৈরি করেছে আবার ভঙ্গ করেছে। আইন বহির্ভূত পথে যে মানুষ চলতে গিয়েছে তার পক্ষে জনমত সায় দেয়নি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ এবং মাৎসন্যায়ও দেখা দিয়েছে। কিন্তু তা ছিল সাময়িক। তার কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। একদলের পরে আর এক দল এবং এক জাতির পরে আর এক জাতি। অন্তবর্তীকালে হয়তো কিছুটা অনিয়ম হতে পারে। কিন্তু মানুষ আবার আইন ও শৃংখলায় ফিরে এসেছে। এটাই মানবিক ঐতিহ্য। এটাই আল্লাহর নিয়ম। এভাবে আল্লাহ যদি মানুষদের একদলের সাহায্যে অন্যদলকে প্রতিহত না করতেন তাহলে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় দেখা দিতো। কিন্তু দুনিয়াবাসীদের প্রতি আল্লাহর অপার করুণা (যে, তিনি এভাবে বিপর্যয় রোধের ব্যবস্থা করেন।)।’[আল-বাকারা: ২৫১] ‘আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে দিয়ে অন্যদলকে প্রতিহত না করতেন তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেতো খ্রস্ট্রীয় সংসার, বিরাগীদের উপাসনাস্থান, গীর্জা, ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ যেখানে বেশি বেশি স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে (অর্থাৎ তাঁর ব্যবস্থাপনাকে) সাহায্য করে। আল্লাহ অবশ্যই শক্তিমান ও পরাক্রমশালী।’ (আল হাজ্জ : ৪০)
মানুষের ইতিহাস আইন ভঙ্গ করার নয়, আইন মেনে চলার ইতিহাস। কিন্তু মানুষ কৌশলে আইন অমান্য করে। এর পরিণামও হয় ভয়াবহ। আল্লাহ আইন করে দিলেন, ইহুদিরা শনিবার মাছ ধরবে না। কিন্তু শনিবার পানির উপরিভাগে বেশি বেশি মাছের আর্বিভাব দেখে একদল ইহুদি লোভ সামলাতে পারলো না। তারা দরিয়ার পাশে পুকুর কাটলো এবং শনিবার সেই পুকুরের সাথে দরিয়ার সংযোগ করে দিল। শনিবার পুকুরে মাছ ভরে গেলে তারা সংযোগ মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় অতি উৎসাহে সে মাছগুলো ধরতে লাগলো। এভাবে তারা আল্লাহর আইন অমান্য করার জন্য কৌশল অবলম্বন করো। একদল তাদের এই শঠতার পথ পরিহার করতে বললো কিন্তু আর একটি দল চুপ থাকলো। আল্লাহ এই নীরব দর্শক ও কৌশলে আইন অমান্যকারী দুটি দলকে চরম শাস্তি দিলেন। এভাবে কৌশল অবলম্বন করাকে কুরআনের ভাষায় ‘মকর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধরনের মকর মানে দুষ্টবুদ্ধি, ছল, চাতুরী, ধোকা, প্রতারণা। আর একটি মকরকে কুরআনে ভালো কৌশল হিসাবে বর্ণনা করে একে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘ওয়াল্লাহু খায়রুল মাকেরীন’Ñআল্লাহ শ্রেষ্ঠ কৌশলবিদ। (আলে-ইমরান : ৫৪)
আর প্রথম প্রকারের মকর তথা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আইন অমান্য করা সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তাদের পূর্ববর্তীরা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহ তাদের ইমারতের অর্থাৎ চক্রান্তের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছিলেন। ফলে ইমারতের ছাদ তাদের ওপর ধসে পড়লো এবং তাদের প্রতি আযাব এলো এমন দিক থেকে যা ছিল তাদের ধারণার অতীত।’ (আন-নহল : ৪৫-৪৭) ‘আর হে মুহাম্মদ, স্মরণ করো, কাফেররা যখন তোমাকে বন্দী, হত্যা বা নির্বাসিত করার জন্য মকর তথা চক্রান্ত করে, আর তারা চক্রান্ত করে এবং আল্লাহও কৌশল করেন। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (আল-আনফাল : ৩০) ‘কাজেই দেখো তাদের চক্রান্তের (মকর) পরিণাম কি হয়েছে। আমি অবশ্যই তাদের এবং তাদের স¤প্রদায়ের সবাইকে ধ্বংস করেছি। এই তো সীমালংঘন করার কারণে তাদের ঘরবাড়ি জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। এতে জ্ঞানী স¤প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (আন নমল ৫১ ও ৫২)
এই প্রতারণামূলকভাবে আইন অবমাননাকারীদের ব্যাপারে কুরআনে আর এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, এদেরকে ছেড়ে দাও, এই মিথ্যাচারীদের লাগাম ঢিলে করে দাও। ’ওয়া মাহ্হিলহুম তামহীলা’Ñকিছুকালের জন্য এদেরকে অবকাশ দাও। দেখো এরা কতদূর যায়। (আল-মুয্যামমিল : ২১) অর্থাৎ ছলনা ও প্রতারণামূলকভাবে আইন অমান্য করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে সব যুগে ছিল। তবে আজকের যুগে তা প্রচÐ রূপ নিয়েছে। বিশ একুশ শতকের বিশ্বে আজ আইনই সবচেয়ে বড় শক্তি আবার সমস্ত কিছু বেআইনী ও গর্হিত কাজ করার জন্য আইনকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরো আমেরিকান সভ্যতা এক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিগত কয়েক শো বছর থেকে বিশ্ববাসীকে তারা যিম্মি করে রেখেছে। ছল ও প্রতারণার সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শাসন কায়েম করে ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বকে তারা নিজেদের মুঠোয় নিয়েছিল। তারপর জনতার সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিজেদের মুঠো ঢিলে করলেও দু’দুটো বিশ্ব যুদ্ধের পর প্রতারণার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। সমস্ত স্বাধীন জাতিদের কেন্দ্রীয় জাতিসংস্থা (জাতিসংঘ) বানিয়ে সেখানে সারা বিশ্বের নিরাপত্তার দায়িত্ব সমগোত্রীয় হাতে গোনা কয়েকটি জাতির হাতে তুলে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্যের নামে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং সমজাতীয় কয়েকটি ব্যাংক ও সংস্থা কায়েম করে সারা দুনিয়ার সবদেশের অর্থভান্ডারের চাবিকাঠি নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। প্রচার যন্ত্র ও মিডিয়াকে এত বেশি শক্তিশালী করেছে যে নিজেদের কণ্ঠ ছাড়া আর সব কন্ঠই সেখানে নিস্তেজ। তারা যার চেহারাকে যেভাবে দেখাতে চায় ঠিক সেভাবেই দেখা যাচ্ছে ও দেখা হচ্ছে। প্রতারণামূলক আইনের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে তারা নিজেদের প্রভাব বলয়ে আটকে রেখেছে।
সমরাস্ত্র প্রতি যুগে জাতিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাই সমরাস্ত্রের সমস্ত চাবিকাঠি তারা নিজেদের কব্জায় রেখে দিয়েছে। বিশ্ব বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমাগুলো কেবল তারাই ব্যবহার করতে পারবে আর কেউ নয়। এজন্য তারা আইনের বেড়াজাল সৃষ্টি করেছে, যাতে এ বেড়াজাল অতিক্রম করে অন্য কেউ এ চাবিকাঠিতে হাত দিতে না পারে। সারা বিশ্বে মানবাধিকার লংঘনের ধূয়া তুলে তারা একচেটিয়াভাবে মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। সততা, নৈতিকতা, ন্যায়, ইনসাফ, মানবাধিকার তাদের একচেটিয়া সম্পত্তি। অন্যদের এর ওপর কোনো অধিকার নেই। তাদের কাছে অনেক প্রাচীন আসমানী কিতাব আছে। সেগুলোর মধ্যে অনেক সত্য কথা আছে। তাদের কাছে অনেক উন্নতমানের দর্শন আছে। অনেক জ্ঞানী লোকের অমূল্য বাণী আছে। যেগুলো জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করতে পারে। কিন্তু এসবের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। নিজেদের স্বার্থ ও জাগতিক ক্ষুধা প্রশমন ছাড়া নীতি-নৈতিকতা-ন্যায়-ইনসাফের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানবতার বিরুদ্ধে চক্রান্তমূলক আইন (মকর) তৈরি করে তারা বিশ্ব মানবতার শান্তি, ধৈর্য ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। সভ্যতা ও মানবিক সংস্কৃতির ভিত্তিমূলে আঘাত হানছে।
এই ইউরো আমেরিকান সভ্যতা সারা বিশ্বে যে সংস্কৃতি চর্চার জোয়ার প্রবাহিত করেছে তা হচ্ছে আইনের আশ্রয় নিয়ে যাবতীয় বেআইনী, গর্হিত এবং সভ্যতা ও মানবতা বিধ্বংসী কাজ করতে হবে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে সন্ত্রাসের প্রতারণা জাল (মকর) বিছিয়ে এই সভ্যতার ধ্বজাধারী দেশগুলোর আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানের মুসলমানদের নিধনযজ্ঞ পরিচালনা। আমেরিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ-২০০১ এর নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তান আক্রমণের প্রাক্কালে বলেছিলেন, এই সবে শুরু, এখন আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে বহু বছর। তখন দুনিয়ার মানুষ তার এ কথার তাৎপর্য যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু আজ আট বছরের অর্থহীন ও নিষ্ফল যুদ্ধের পর মানুষ যথার্থই অনুধাবন করছে মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও মানবিকতাকে ধ্বংস করে একটা দানবীয় সভ্যতার কাঠামো তৈরি করা ছাড়া এ যুদ্ধের দ্বিতীয় কোনো লক্ষ নেই। ইউরো আমেরিকান সভ্যতা আইনের নামে বেআইনী কাজ করে এবং আইনের আশ্রয় নিয়ে আইনের অবমাননা করে সমগ্র বিশ্বমানবতা ও মানবিক সভ্যতাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অথচ আইনই মানুষের জীবন। আইনের প্রতি মর্যাদা প্রদানের ভিত্তিতে মানুষের সভ্যতা জীবনীশক্তি লাভ করে। কাজেই সেই অমোঘ বিধান কার্যকর হবার সময় আবার এসে যাচ্ছে যাতে বলা হয়েছে, ‘ওয়া লাও লা দাফ্উল্লাহিন্নাসা বা’দাহুম বিবা’দিন লাফাসাদাতিল আরদ্, ওয়া লাকিন্নাল্লাহা যু-ফাদলিন আলাল আলামীন’ ‘আল্লাহ যদি মানব জাতির একদলকে অন্যদল দিয়ে প্রতিহত না করতেন তাহলে দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু মহান আল্লাহ জগতবাসীদের প্রতি অপার করুণাশীল। (আল-বাকারা : ২৫২) ছশো কোটি বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহর করুণাধারা এখনো নিশেষ ও নিস্তব্ধ হয়ে যায়নি। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ কৌশলবিদ।