মিশিগানে কনস্যুলেট সেবা নিয়ে দ্বন্দ্ব: কমিউনিটিতে অসন্তোষ, হতাশ প্রবাসীরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:২৮:৫৩,অপরাহ্ন ২৩ আগস্ট ২০২২
সাহেল আহমদ, যুক্তরাষ্ট্র (মিশিগান) থেকে:
প্রায় লাখো প্রবাসী বাংলাদেশিদের আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে কনস্যুলেট সেবা কার্যক্রমকে ঘিরে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। সারা বছর বিড়ম্বনা পোহানো মিশিগানের প্রবাসীদের ৩-৪ দিনের অস্থায়ী কনস্যুলেট সেবাটা ছিল সোনার হরিণ। কিন্তু নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এবছর অস্থায়ী কনস্যুলেট সেবার বদলে প্রবাসীদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) থেকে শুরু করে সোমবার পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট সেবার আয়োজন করে। তবে প্রথমদিন দূতাবাসের সাময়িক সেবার শৃঙ্খলা থাকলেও দ্বিতীয় দিনে (শনিবার) আয়োজকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেখা দেয় আতঙ্ক। কমিউনিটিজুড়ে বিরাজ করে থমথমে অবস্থা। পরেরদিন রবিবার সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বিকেলে দূতাবাস কর্মকর্তাদের লাঞ্চিত করার অভিযোগ এনে সোমবার শেষদিনের কনস্যুলেট সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। অপ্রীতিকর এ ঘটনায় বিপুল সংখ্যক প্রবাসী সেবাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মিশিগানের বাঙালি কমিউনিটিতে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, হ্যামট্রামিক সিটির আমিন রিয়েলেটি অফিসে চার দিনব্যাপী ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট সেবার ২য় দিনে (শনিবার) সকাল থেকেই স্বজনপ্রীতি, অ্যাপয়েন্টমন্ট ছাড়া সেবা দান, আর্থিক লেনদেন, দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাজে আয়োজক কমিটির সদস্যদের হস্তক্ষেপসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। এনিয়ে বিকেলে অনিয়মের অভিযোগে আয়োজক কমিটির সদস্য আহাদ আহমেদ’র সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন আয়োজক কমিটির সদস্য মিশিগান মহানগর আওয়ামী লীগের দুই নেতা । ঘটনার জানাজানি হলে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মুহুর্তেই ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট ক্যাম্পে চলে আসেন। এ সময় তাঁরা ক্যাম্পের ভেতরে ঢুঁকে আয়োজক কমিটির সদস্য আহাদ আহমেদ’র ওপর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে অবরুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেন। এমন পরিস্থিতিতে সেবা নিতে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে হ্যামট্রামেক সিটি পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়ে কারণ জানতে চাইলে ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট ক্যাম্পের স্থানীয় আয়োজকরা তুচ্ছ ঘটনা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
তবে দূতাবাসের প্রথম সচিব (পাসপোর্ট ও ভিসা) আবদুল হাই মিল্টন জানান, আরও আগে মিশিগানে ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে আয়োজন করতে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। চার সংগঠনের আটজনকে সমন্বয় করে আমরা অস্থায়ী কনস্যুলেট সেবা কার্যক্রম শুরু করি। তবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে আয়োজক কমিটির সদস্য স্টেইট আওয়ামী লীগ’র সাধারণ সম্পাদক আবু আহমেদ মুসার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বিস্তারিত জানানোর আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে তড়িঘড়ি করে দূতাবাস কর্মকর্তাদের নিয়ে চলে যান। এনিয়ে শনিবার মধ্যরাতে মিশিগান মহানগর আওয়ামী লীগ’র সভাপতি আব্দুস শুকুর খান মাখন ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মোতালিব বলেন, সেবাগ্রহণকারী কয়েকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা আয়োজক কমিটির এক সদস্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, অ্যাপয়েন্টমন্ট ছাড়া সেবা দানের সত্যতা পাই। এনিয়ে আমাদের আয়োজকদের মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। তবে রবিবার এসকল অভিযোগ অস্বীকার করে মিশিগান বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি আহাদ আহমেদ বলেন, আয়োজক কমিটির সদস্য মিশিগান মহানগর আওয়ামী লীগ’র নেতারা মাস্তানদের ডেকে এনে এমন অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করেন।
এদিকে পরেরদিন রবিবার সকাল থেকে কনস্যুলেট ক্যাম্পে প্রবাসী সেবাগ্রহীতারা দীর্ঘ লাইনে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ই-পাসপোর্ট, নো ভিসা রিকোয়ার্ড, দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদসহ নানান সেবা গ্রহণ করেন। ঐদিন সন্ধ্যার দিকে কনস্যুলেট সার্ভিসের কর্মকর্তারা ডেট্রয়েট সিটির ডাউনটাউন ঘুরতে গেলে জিএম বিল্ডিংয়ের সামনে তাঁদের (কর্মকর্তাদের) ওপর আকিকুল হক শামীম, শাকের উদ্দিন সাদেক, মোরশেদ ও রায়হানসহ ৭-৮ জন ব্যক্তি চড়াও হন বলে অভিযোগ করা হয়। স্থায়ী কন্স্যুলেট অফিসের জন্য স্মারকলিপি দিতে গিয়ে দূতাবাস কর্মকর্তাদের সাথে অশোভন আচরণ ও লাঞ্চিত করার এ অভিযোগ করেন ঘটনাস্থলে সাথে থাকা আয়োজক কমিটির সদস্য সুমন কবির। তবে লাঞ্চিত করার অভিযোগ অস্বীকার করে শাকের উদ্দিন সাদেক বলেন, দূতাবাস কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের কিছুটা বাকবিতণ্ডা হয়। পরবর্তীতে কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়টি মীমাংসাও করে চলে আসি।
এদিকে ঘটনার জেরে দূতাবাস কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাজনিত কারণে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই চতুর্থ দিনের (সোমবার) কনস্যুলেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। সোমবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট ক্যাম্পে বাংলাদেশি প্রবাসী অনেকেই অ্যাপয়েন্টমন্ট অনুযায়ী জড়ো হতে থাকেন। কাউকে না জানিয়ে এভাবে সেবা বন্ধ করে চলে যাওয়া ও আয়োজক কমিটির কেউ সার্ভিস বন্ধের ব্যাপারে কোনো প্রকার ঘোষণা না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কাজের দিন অনেকে ছুটি নিয়ে কনস্যুলেট সেবা না পাওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে যান।
অপরদিকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কনস্যুলেট ক্যাম্প’র আয়োজক কমিটির সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, শনিবার দ্বিতীয় দিন বহিরাগত কিছু লোক সার্ভিস বন্ধের জন্য চেষ্টা করে। তৃতীয় দিন সোমবার দূতাবাস কর্মকর্তারা ডেট্রয়েট ডাউনটাউন দেখতে গেলে ঐখানে স্মারকলিপির কাগজ হস্তান্তরের কথা বলে দেশীয় কায়দায় ৮-৯ জনের একটি দল অতিথিসহ সবাইকে ঘেরাও করে। দূতাবাসের প্রথম সচিব (পাসপোর্ট ও ভিসা) আবদুল হাই মিল্টন তাঁদেরকে কাগজটি ইমেইল কিংবা মেইলের মাধ্যমে পাঠানোর অনুরোধ করেন। এ সময় শাকের উদ্দিন সাদেক’র নেতৃত্বে আকিকুল হক শামীম,মোরশেদ ও রায়হানসহ কয়েকজন ব্যক্তি কর্মকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। তাঁরা দূতাবাস কর্মকর্তাদের শারিরীকভাবে নির্যাতনের চেষ্টা চালান বলে সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক কমিটির সদস্যরা বিষয়টি তুলে ধরেন।
এ ব্যাপারে দূতাবাসের প্রথম সচিব (পাসপোর্ট ও ভিসা) মুহাম্মদ আবদুল হাই মিল্টন’র সাথে বার বার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও উনি সাড়া দেননি।