মানুষ আর পারছে না
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৪১:২৬,অপরাহ্ন ১৩ আগস্ট ২০২২
বড় একটা ব্যাগ হাতে কাওরান বাজারে রাহেলা বেগম। সঙ্গে তার স্বামী। চোখে মুখে হতাশার ছাপ। বাজারের ফুটপাথ থেকে কিনছেন সবজি। কিন্তু ব্যাগ আর ভরে উঠছে না। পান্থপথ এলাকায় একটি রিকশা গ্যারেজে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। গ্যারেজের দেখাশোনা করেন স্বামী। আর রাহেলা রিকশাচালকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সবমিলিয়ে দুপুরে তার খাওয়াতে হয় ২৫ থেকে ৩০ জনকে। আর রাতে খাওয়াতে হয় কমপক্ষে ৫০ জনকে।
সবাই তাকে রাহেলা খালা বলেই ডাকে।
রাহেলা বলেন, আগে ৫০ টাকা করে খাওয়ার খরচ নিতাম। এর আগেরবার তেলের দাম বাড়ার সময় ৬০ টাকা করে নেই। ১০ টাকা বাড়ানোর কারণে অনেক রিকশাওয়ালা আর দুপুরে খায় না। এখন আমার একদিনে আধাকেজি মরিচ লাগে। মরিচের কেজি ১৮০ টাকা। একবেলা একেকজনের জন্য এক পোয়া করে চাল রান্ধা লাগে। বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো চাল নাই। সয়াবিন তেলের দাম ১৯০ টাকা কীভাবে চলি?
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দাম করছিলেন লাউয়ের। ৪০ টাকা করে কিনলেন ২টি লাউ। বলেন, রাতে সবজি রান্না করবো। ক’দিন আগেও এই লাউ ২০/২৫ টাকা করে কিনছি। এতগুলা মানুষকে খাওয়ায় আমার দিনে লাভ হইতো ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখন এমন অবস্থা হইছে ৫০০ টাকাও লাভ থাকে না। একটা করে যে ডিম দেবো সেটাই পারি না। ডিমের হালি ৪৮/৫০ টাকা। আবার যে খাওয়ার খরচ ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা করবো সেই সাহসও পাই না। দেখা যাবে আরও খাওয়ার লোক কমে যাবে।
রাজধানীর বৃহৎ কাঁচাবাজার কাওরান বাজার। এই বাজারে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক লোকের সমাগম ঘটে। বাজারে বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে দেখা যায়, চাপা ক্ষোভ ও অসহায়ত্ব বিরাজ করছে সবার মাঝে। বাড়তি বাজারের মাঝে হুট করে তেলের মূল্যের লাভ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের চাপে অসহায় মানুষ। আর বাড়তি দামের সঙ্গে মানিয়ে নিতে খাবি খাচ্ছেন সবাই।
ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না মো. আলী। বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। গ্রিনরোড এলাকায় একটি বাড়ি দেখভালের কাজ করেন তিনি। সেই বাড়িতেই থাকেন স্ত্রীসহ। বেতন পান আট হাজার টাকা। চার ছেলেমেয়ের বিয়ের পর থাকেন অন্যত্র। তার স্ত্রী কাজ করে দুটি বাড়িতে। এই নিয়ে মোট ১২ হাজার টাকা আয় তার।
আলী বলেন, এক বছর হইলো চোখে ছানি পড়া শুরু হইছে। ডাক্তার দেখাবো সেই সাহস পাই না। আগে সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন ব্রয়লার মুরগি না হইলে মাছ কিনতাম। এখন ঈদের পর থেকে আর সবজি ছাড়া কিছু খাইতে পারি নাই। প্রতিদিন আমাগো ১০০ টাকার মতো ওষুধ খাওয়া লাগে। দিনে চাল কিনা লাগে এক কেজি। মাস শেষে কিস্তি দেওন লাগে ৩০০ টাকা। এরপর যা থাকে তা দিয়া সবজি, তেল, ডাল কেনার পর আর টাকা থাকে না। আগে মুরগি, মাছ না হইলেও একটু সবজি দিয়া প্যাট ভইরা খাইতাম। এহন সকালে পিয়াজ দিয়া পান্তা খাই।
করোনার সময় চাকরি হারিয়েছেন আলী ইমতিয়াজ সজীব। এরপর একটা চাকরি জোটালেও পরিবার রেখে এসেছেন নিজ বাড়ি রংপুরে। এখন আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বেতন পান ২২ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আগের চাকরিতে বেতন পাইতাম ৩৫ হাজার টাকা। এক ধাক্কায় বেতন কমে গেছে ১৩ হাজার টাকা। চাকরি না থাকা অবস্থায় ঋণ করেছিলাম অনেক টাকা। এখনো ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করা বাকি। মাসে বাড়িতে পাঠাতে হয় ১৫ হাজার টাকা। একটা ছেলে আছে আমার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই টাকায় তাদের সংসারও চলে না। আমার উপায়ও নাই। আমার থাকে সাত হাজার টাকা এই টাকা থেকে দুই হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করি। বাকি টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। আবার প্রতি মাস শেষে কোনো না কোনো কারণে ঋণ করতেই হচ্ছে আমাকে।
তিনি আরও বলেন, একটা ডিপিএস চালাইতাম। মাসে ধারদেনা করে হলেও এক হাজার টাকা করে সঞ্চয় হইতো। এইবার ঈদের সময় সেটাও ভেঙে ফেললাম। আগের মূল্যের সঙ্গেই খাপ খাওয়ায় নিতে পারি নাই। এখন তো নতুন করে সবকিছুর দাম বাড়লো। হোটেলে একটা ডিম দিয়ে ভাত খাইতে ৫০ টাকা লাগে। এটা মানা যায়?
মৃন্ময়ী দাস একজন গৃহিণী। তার স্বামী একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। আগে আমরা ব্রয়লার মুরগি খেতাম না। পরিবারের লোকজনরাও খেতে চায় না। কিন্তু এখন প্রায়শই ব্রয়লার মুরগি কিনতে হচ্ছে। আবার সেইসঙ্গে আগে বাড়িতে কেউ পাঙ্গাস, তেলাপিয়া মাছ খেতো না রান্নাও হতো না এখন তো কিনতেই হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় ১৪ হাজার টাকা। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে ক’দিন আর দাদির রুমে রাখতে পারবো। তিন রুমের একটা বাসা নেয়া প্রয়োজন কিন্তু পারছি আর কই। লেখাপড়ার খরচ বাড়ছে। আবার বেঁচে থাকার তাগিদে ছোট করতে হচ্ছে বাজারের ফর্দ। গাইবান্ধায় রিকশাচালক মজিবর রহমান। ঢাকায় এক দেড় মাস রিকশা চালিয়ে বাড়ি যান। আবার কিছুদিন থেকে ফিরে আসেন ঢাকায়। মজিবর বলেন, দিনে আমার ছয়শ’ টাকার মতো আয় হয়। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার পর আমরা ভাড়া বাড়াবো কি এখন দেখি আগের ভাড়াতেও মানুষ রিকশায় ওঠে না। আগে এখন দিনশেষে একশ’ দেড়শ’ টাকা আয় কমে গেছে। আমার বাড়িতে ছয়জনের সংসার। অপেক্ষায় আছি কবে শুনবো বাড়িতে চাল নাই। পরিবার না খেয়ে আছে।
তিনি বলেন, আমরা মেস কইরা থাকি। সপ্তাহে একদিন বাজার করা লাগে। প্রতিবেলা খাওয়ার জন্য ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ হয়। কাল বাজার করতে যায়া দেখি চাল আর তেল কেনার পর কোনো টাকা নাই। ডাল আর আলু ভর্তা খায়া বেঁচে আছি। রিকশা চালাই এই খাবার খায়া শরীরে বল পাই না। এভাবে চললে তো শরীরটাও ছাড়ে দেবে।
ঊর্ধ্বগতির বাজারে নাজেহাল মানুষ। সবথেকে বেশি বেকায়দায় আছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। আবার নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাসা ভাড়া বৃদ্ধির। বাড়তির দিকে সবই, কমছে না যেন কোনো কিছুর মূল্যই। কাওরানবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী আজমত হোসেন বলেন, গত বুধবার মুরগি আনার জন্য পিকআপ ভাড়া লাগছে ২৫০০ টাকা। আর আজ লাগলো ৩৫০০ টাকা। আবার খামারিরা মুরগির কেজিতে দাম বাড়ায় দিছে আমাদের দাম না বাড়ায় তো কোনো উপায় নাই।
পাইকারি এই বিক্রেতা বলেন, শুক্রবারের জন্য বাড়তি মুরগি আনি আমরা। প্রতি সপ্তাহেই বিক্রি কমতেছে। গত শুক্রবার বিক্রি করছি আট হাজার মুরগি। এই সপ্তাহে মুরগি বিক্রি হইছে সাড়ে ছয় হাজারের মতো। অন্যদিন মুরগি বিক্রি হয় ছয় হাজার পিস। এখন প্রতিদিন এখন এক হাজার পিস মুরগি কম বিক্রি কম হয়। ১০০ পিস মুরগি বিক্রি করে আগে যা লাভ হতো তার থেকে এখন ২০ শতাংশ লাভ কম হয়।