ওসমানী শান্ত কাজলশাহে ভয়, আতঙ্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ আগস্ট ২০২২, ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ
মাদ্রাসাছাত্র মৃদুল। বাড়ি ওসমানী মেডিকেলের পাশে কাজলশাহে। সহপাঠীর অসুস্থতার খবর পেয়ে মৃদুল যান মেডিকেলে। সিট দেয়ার কথা বলে মৃদুলের ওই সহপাঠীর কাছ থেকে ৬০০ টাকা ‘বকশিশ’ নেয় ওয়ার্ড বয়। কিন্তু সিট দেয়নি। মৃদুল হাসপাতালে গিয়ে টাকা কেন নেয়া হলো জানতে চায়। এতে ক্ষুব্ধ হন ওয়ার্ডের কর্মচারীরা। এ নিয়ে মৃদুলের সঙ্গে তার হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। দৃশ্য দেখে ছুটে আসেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। খবর পেয়ে কাজলশাহ্ এলাকার বাসা থেকে মৃদুলের বড় ভাই ছাত্রলীগ কর্মী আব্দুল্লাহ সেখানে যান।
সঙ্গে আরও কয়েকজন। তর্কাতর্কির একপর্যায়ে আব্দুল্লাহর সঙ্গে ইন্টার্ন চিকিৎসকদেরও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আব্দুল্লাহ ও তার ভাই মৃদুলকে ক্যাম্প পুলিশের হাতে তুলে দেন। এ ঘটনা শনিবারের। আব্দুল্লাহ ও মৃদুলের চাচা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক। খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। মুচলেকা দিয়ে পুলিশ ক্যাম্প থেকে আব্দুল্লাহ ও মৃদুলকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। গতকাল বিকালে মানবজমিনকে এ তথ্য জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালিক। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এর কারণ- ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে পার্শ্ববর্তী কাজলশাহ্ এলাকার ছাত্রলীগ কর্মীদের।
কাজলশাহ্ ছাত্রলীগের ওই অংশের নেতা আব্দুল্লাহ। আগে নেতা ছিলেন রায়হান। টিলাগড় গ্রুপের নেতা। মাদক সহ র্যাব’র হাতে গ্রেপ্তারের পর রায়হান চুপসে গেছেন। এরপর থেকে আব্দুল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করেন কাজলশাহ এলাকার ছাত্রলীগের ওই গ্রুপকে। মেডিকেলের প্রধান ফটক ও কাজলশাহ্ এলাকা পাশাপাশি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- ১ নম্বর ফটকের কাছে মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরাও আড্ডা দেয়। তার পাশেই কাজলশাহর ওই গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মীদের অবস্থান। শনিবারের ঘটনার জের ধরে সোমবার রাত ৯টার দিকে যখন মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী ওই এলাকায় যায় তখন কাজল শাহ্ এলাকার ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের ধাওয়া করে। এ সময় মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী ও শিক্ষার্থীরা একত্রে মিলে পাল্টা ধাওয়া করে। দু’পক্ষের মধ্যে ওই এলাকায় প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া পাল্টা- ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশও যায় এলাকায়। এ ঘটনায় মেডিকেল কলেজের দুই ছাত্র আহত হয়। তাদের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর খবর পেয়ে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে মেডিকেল এলাকা। ঘটনায় ক্ষুব্ধ কলেজের শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রাতেই রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এবং কর্ম বিরতির ডাক দেন। পুলিশ রাতে অভিযান চালিয়ে কাজলশাহ্ এলাকার ছাত্রলীগকর্মী রাব্বী ও এহসানকে গ্রেপ্তার করে। এহসান হচ্ছে ছাত্রলীগ কর্মী ও হামলাকারী অংশের দলনেতা আব্দুল্লাহ্র ভাই।
দু’জন গ্রেপ্তার হলেও মেডিকেলের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা শান্ত হয়নি। তাদের দাবি- সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে আসামিদের গ্রেপ্তার। এ কারণে মঙ্গলবার সিলেট আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, মেডিকেল ও কলেজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশের কর্মকর্তাদের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠকে আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা সেই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারেননি। এরপর থেকে তারা মেডিকেলে কর্মবিরতি এবং কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত রাখেন। বুধবার সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভের পর বিকালে দেয়া হয় শেষ আল্টিমেটাম। সেখানে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার না করলে আউটডোর সহ সব সেবা বন্ধের ঘোষণা দেন। এতে আরও চাপের মুখে পড়ে পুলিশ সহ আইন শৃঙ্খলাকারী বাহিনীর ওপর। তার আগে অবশ্য মেডিকেল কলেজে নিরাপত্তা বাড়ানো, পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন সহ ৪ দফা দাবি মেনে নেয় কলেজ ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। ফলে শেষ দিকে এসে ইন্টার্ন ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দাবি ঠেকেছিল এক দফায়। সেটি হচ্ছে- সিসিটিভি’র ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামিদের গ্রেপ্তার এবং দু’টি মামলাও দায়ের করা হয়।
সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা রাব্বী ও এহসানকে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বুধবার মধ্যরাতে পুলিশ দিব্য সরকার নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। দিব্য হচ্ছে কাজলশাহ্ এলাকার ৫২নং বাসার রমণীকান্ত সরকারের ছেলে। সে কাজলশাহ্ এলাকার ছাত্রলীগকর্মী। সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি আলী মাহমুদ জানিয়েছেন- শাহ্পরাণ এলাকা থেকে দিব্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে হামলা ঘটনার দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি। হামলার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাতে দিব্যকে গ্রেপ্তারের পর মেডিকেলের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সকালে ওসমানী হাসপাতালে আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি ডা. এনায়েত হোসেন মুকুল, সিলেটের শেষ ফজিলাতুন্নেছা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী, স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায়। কলেজ ভবনে তারা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. ময়নুল হক সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখান যান ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে সব আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস প্রদান করলে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা আশ্বস্ত হন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডা. আহমেদ মুনতাকিম চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন- ‘যেহেতু প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সে কারণে আমরা ৭ দিনের জন্য ধর্মঘট স্থগিত করেছি। ওই ৭ দিনের মধ্যে সব আসামিদের গ্রেপ্তার না করলে ফের আন্দোলন শুরু হবে বলে জানান তিনি।’ মুনতাকিম জানান- ‘আমরা কখনোই সিলেটের মানুষের সেবা বন্ধ করিনি। জরুরি বিভাগ ও কার্ডিওলজি বিভাগে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেয়া হয়েছে। ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের নিরাত্তার বিষয়টি চিন্তা করে আমরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছি। এখন থেকে সব স্বাভাবিক হলো।’ এদিকে- তার এই ঘোষণার পর বৈঠকস্থল থেকে বেরিয়ে আসেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি ডা. এনায়েত হোসেন মুকুল। তিনি সাংবাদিকদের জানান- ‘সবার আগে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে মানুষের সেবা। বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কাজে ফিরেছেন। উত্থাপিত দাবি পূরণে আমরা সচেষ্ট থাকবো। একই সঙ্গে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরেছে।’
পরে ডিজি ডা. এনায়েত হোসেন মুকুল ও ভিসি ডা. মুর্শেদ আহমদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা মেডিকেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের সেবা প্রদান শুরু করেন। ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন- ‘যেহেতু আসামিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে; হাসপাতালে থাকা রোগীদের কথা চিন্তা করে চিকিৎসা সেবা শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্লাস ও পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ফিরেছে। বাড়ানো হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। এ কারণে আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করে সবাই কাজে ফিরেছে।’ এদিকে- পুলিশের গ্রেপ্তার হওয়া কাজলশাহ্ ছাত্রলীগের কর্মী দিব্য সরকারকে গতকাল দুপুরে আদালতে হাজির করে পুলিশ। তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) ইয়াসিনুর রহমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘বিকেলে আসামি দিব্য সরকারের ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। রোববার নাগাদ রিমান্ড শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।’ আব্দুল্লাহ কোথায়: ওসমানী মেডিকেলে ঘটনার মূল হোতা আব্দুল্লাহ ও তার ভাই মৃদুল। তাদের খোঁজে গত তিনদিন দফায় দফায় কাজলশাহ্ এলাকার বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কিন্তু পাওয়া যায়নি। তবে- গতকাল বিকালে আব্দুল্লাহর চাচা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক জানিয়েছেন- ‘আব্দুল্লাহ কোথায় সেটি পরিবারও জানে না। দিব্যকে যেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সেখানেই আব্দুল্লাহ ছিল। কোতোয়ালির ওসি দিব্যকে গ্রেপ্তারের পর ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত করলেও আব্দুল্লাহর ব্যাপারে কিছু বলেননি। এরপর থেকে আব্দুল্লাহকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দাবি করেন তিনি।’ বলেন- ‘পরিবারের সঙ্গেও আব্দুল্লাহর যোগাযোগ নেই। এ কারণে আব্দুল্লাহকে ঘিরে তাদের নানা সন্দেহ। দুশ্চিন্তাও বাড়ছে। থানায় সাধারণ ডায়েরি করতেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
সংবাদ সম্মেলন করবেন কি না সেটিও এই মুহূর্তে বুঝতে পারছেন না বলে জানান আব্দুল খালিক।’ তিনি দাবি করেন- ‘তুচ্ছ ঘটনায় আমরা অসহায় হয়ে গেলাম। এলাকার অনেক বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। এসব বিষয়ে তিনি এলাকার লোকজনকে নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা করছেন বলে জানান।’ কাজলশাহ্ এলাকার বাসিন্দা, বর্তমান লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক রাহুল তালুকদার পাপ্পু গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘কাজলশাহ্ এলাকায় তার বাসায় পুলিশও অভিযান চালিয়েছে। তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ভাতিজা সানীর খোঁজে পুলিশ এ অভিযান চালায়।’ তিনি দাবি করেন- ‘তার ভাতিজা সানী ঘটনার দিন মেডিকেল কিংবা ১ নম্বর ফটক এলাকায় যায়নি। অন্যদের প্ররোচনায় সত্যতা যাচাই না করেই পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। শুধু তার বাসায়ই নয়, এইচএসসি পরীক্ষার্থী অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালানো হচ্ছে। এ কারণে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান তিনি।’