সন্ধ্যা নামলেই শহরজুড়ে ‘ছাত্রলীগ’ আতঙ্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২২:৩৬,অপরাহ্ন ০৩ আগস্ট ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
পুলিশ সুপার বলেন, ‘শনিবার শহরের ধর্মতলায় সংঘর্ষ হওয়ার পর আমরা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছি। শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা মৌখিকভাবে আমাদের ছাত্রলীগের কর্মসূচির সময় নিজেদের অনিরাপদ মনে করছে এমনটা জানানোর পর আমরা সেখানে টহল বাড়িয়েছি।’
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মারমুখী অবস্থানের কারণে আতঙ্কিত বরগুনার ব্যবসায়ীরা। প্রতিকার চেয়ে তারা পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টহলও জোরদার করেছে পুলিশ। তবে এতে স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি।
ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বিপাকে পড়ার কথা জানিয়েছেন অন্য পেশার মানুষও। তারা বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চান তারা।
ছাত্রলীগ সভাপতি বলছেন, যারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা সংগঠনের কেউ না।
তবে পুলিশ বলছে, নতুন কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের কর্মীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
১৭ জুলাই বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আগে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আবদুর রশিদ রাফির হাতে সভাপতি পদে ২২ ও সাধারণ সম্পাদক পদে ২৬ জনের জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়ে।
সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর ২৪ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন। এতে রেজাউল কবির রেজা সভাপতি ও তৌশিকুর রহমান ইমরানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৩ জনের নাম প্রকাশ করা হয়।
কমিটি ঘোষণার দিন (২৪ জুলাই) বিকেলেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগের একাংশ টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও কমিটি ঘোষণার পর রাত ১০টার দিকে শহরে ঝটিকা মিছিল করে। এতে শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে টানা সোমবার পর্যন্ত প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা দলীয় কার্য়ালয়ের সামনে জড়ো হয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে আসছে।
এর মধ্যে শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের একাংশের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে পৌর শহরের ধর্মতলা মোড়ে এসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা করে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হন।
ওইদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বরগুনা জেলা স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি উত্তম কর্মকার। ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাড়ে ৮টার দিকে ছাত্রলীগের শতাধিক তরুণ লাঠিসোঁটা হাতে মিছিল নিয়ে শহরের ধর্মতলা মোড়ে আসেন। তারা দোকানপাট ভাঙচুরের চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীরা সব বন্ধ করে দেন। পরে তারা ধর্মতলা গলিতে রাখা মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও কয়েকজনকে মারধর করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে উভয় গ্রুপকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’
এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানান উত্তম কর্মকার। পরদিন রোববার সন্ধ্যায় আবারও ছাত্রলীগ কর্মীদের একাংশ শহরে ঝটিকা মিছিল শেষে স্বর্ণকার পট্টি ধর্মতলা মোড়ে জড়ো হয়। এতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন বলে জানান উত্তম কর্মকার।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি রেজাউল কবির রেজার অনুসারী নেতা-কর্মীরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শহরের স্বর্ণকার পট্টির ধর্মতলা গলিতে অবস্থান নেন। অপর গ্রুপটিও মিছিল শেষে স্বর্ণকার পট্টিতে এসে জড়ো হয়। এ সময় একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
‘আমরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মুখোমুখি অবস্থানে ভীতসন্ত্রস্ত। বিষয়টি নিয়ে জেলা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। পুলিশ সুপার টহলের ব্যবস্থাও করেছেন। তারপরও আমরা এমন পরিস্থিতি চাই না। আমরা এর নিরসন চাই।’
ধর্মতলা এলাকার চা ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, ‘এই গলিতে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান রয়েছে। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে আড্ডা দেন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মাঝখানে পড়েছি আমরা। শনিবারের ঘটনার পর যখন মিছিলের শব্দ পাই দোকান বন্ধ করে দেই ভয়ে। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।’
শহরের রিকশাচালক কালাম মিয়া বলেন, ‘ভয়ে সন্ধ্যার পর এখন আর শহরের মধ্যে ট্রিপ দেই না।’
কারা বা কোন নেতারকর্মীরা বিক্ষোভ করছেন তা নিয়ে ছাত্রলীগের কেউ মুখ খুলছেন না। এ বিষয়ে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে এ প্রসঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর হোসাইন বলেন, ‘পদ না পাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতাদের অনুসারী কর্মীরা ক্ষুব্ধ। কারণ, এত বছর ধরে যারা জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য শ্রম দিয়েছেন, যারা অনেক কষ্ট করেছেন, দলের পেছনে বছরের পর বছর ঘুরেছেন, তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মানতে চাইছে না। মিছিল ও সভা তো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। এসব করলে ব্যবসায়ী বা সাধারণের আতঙ্কের কিছু নেই।’
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল কবির রেজা অবশ্য দাবি করেন এসব ঘটনা কোনো গ্রুপিংয়ের কারণে না। তিনি বলেন, ‘আসলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর পরিস্থিতি ঘোলাটে করার পাঁয়তারা করছে। বর্তমান কমিটিতে যারা সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ। এসব যারা করছেন তারা ছাত্রলীগের কেউ না।’
রেজা বলেন, ‘আমরা সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ। এটা যারা মানতে পারছেন না তারা কিছু তরুণকে উসকানি দিয়ে এসব করানোর চেষ্টা করছেন।’
বরগুনার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক বলেন, ‘কমিটি ঘোষণার পর থেকেই বর্তমান কমিটির পক্ষ-বিপক্ষে ছাত্রলীগের কয়েকটি গ্রুপ শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে আসছে। পুলিশ তাদের কর্মসূচির সময় সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘গত শনিবার শহরের ধর্মতলায় সংঘর্ষ হওয়ার পর আমরা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছি। শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা মৌখিকভাবে আমাদের ছাত্রলীগের কর্মসূচির সময় নিজেদের অনিরাপদ মনে করছে এমনটা জানানোর পর সেখানে টহল বাড়িয়েছি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শমভু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করে সমাধানের চেষ্টা করব।’
নিউজবাংলা