মহররম মাসের ফজিলত ও আশুরার তাৎপর্য
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:১১:৩০,অপরাহ্ন ৩১ জুলাই ২০২২
আরবী বছরের প্রথম মাস হলো মহররম। আর এই মহররম মাসে নানা দিক দিয়ে অত্যান্ত ফজিলত পূর্ণ। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন
انٌ عدٌ ة الشهور عند الله اثنا عشر شهرا في كتاب الله يوم خلق السمو ت والأرض منها اربعة حرم
নিশ্চয় যেদিন আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন সেদিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় মাস বারটি,তার মধ্যে বিশেষ চারটি মাস সম্মানিত, এর মধ্যেও মহররম অন্যতম।
মুহররম মাস আমাদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে বিভিন্নভাবে ঈমানদারদের প্রতি রহমত নাযিল করেছেন, কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এ মাস আমাদের কাছে শোকের মাস হিসেবে বেশি পরিচিত। কারণ এ মাসে আমাদের আ‘কা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহলে বায়তের বহু সদস্য এবং নবীজির কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন রাঃ কারবালার ময়দানে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন।
সেদিন থেকে মুহররম বিশেষত ১০ই মুহররম সকল মুসলমান তথা নবী প্রেমিকদের কাছে অত্যন্ত শোকের দিন। কারবালার নির্মম ঘটনার পূর্বেও ১০ই মুহররম বা আশুরা বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে আল্লাহ পাক আদম (আ.) এর দু‘আ কবূল করেন, মুসা (আ.)-এর কওমকে মুক্তি দেন। ইদ্রিস আঃ এদিনে সরাসরি বেহেশতে গমণ করেন আল্লাহ পাক বলেন
واذكر في الكتاب ادريس انه كان صديقا نبينا.ورفعنه مكانا عليا.
স্বরণ করুন ইদ্রিসের কথা, সে ছিল সত্যনিষ্ট নবী,আমি তাহাকে উচ্চে উন্নিত করেছিলাম।
এই মহররম মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আঃ কে এই দিনে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে আল্লাহ পাক উদ্ধার করেছিলেন। হযরত নবী ইউনুস আঃ কে এদিনে মাছের পেট থেকে মুক্তি দান করেন। তাছাড়া আরো বহু ঘটনা এই মহররম মাসের দশ তারিখ সংঘটিত সংঘটিত হওয়ায় ইহাকে আশুরা নামকরণ করা হয়।
আশুরা ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই মহররম মাসের দশ তারিখ ইমাম হোসাইন রাঃ নিজের তাজা রক্ত দিয়ে সঠিক ইসলাম কে জিন্দা রেখেছেন। কিছু সংখ্যক মানুষ হুসাইন (রাঃ) এর অনুপম ত্যাগকে অস্বীকার করা শুরু করেছে আবার শিয়ারা এ দিনকে নিয়ে বাড়াবাড়ী করছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা-বিশ্বাস ধারণকারী হিসেবে আমাদেরকে আশুরা যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে পালন করতে হবে। বিপথগামীদের মতো আশুরার ফযিলতকে অস্বীকার করা যাবেনা আবার ইমাম হোসাইন তথা আহলে বাইতের মহব্বতের নামে অতিরঞ্জিত কিছু করা যাবেনা ।
আশুরার তাৎপর্যঃ
আশুরার ফযিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أفضلُ الصيامِ ، بعدَ رمضانَ ، شهرُ اللهِ المحرمِ . وأفضلُ الصلاةِ ، بعدَ الفريضَةِ ، صلاةُ الليلِ (صحيح مسلم)
রমযানের রোযার পরে সর্বোত্তম রোযা হল মুহররম মাসের রোযা আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের তথা তাহাজ্জুদের নামায। (মুসলিম)
অন্য এক হাদীসে এসেছে:
عن عبدالله بن عباس قال قدم رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ المدينةَ . فوجد اليهودَ يصومون يومَ عاشوراءَ فسُئلوا عن ذلك ؟ فقالوا : هذا اليومُ الذي أظهر اللهُ فيه موسى وبني إسرائيلَ على فرعونَ . فنحن نصومه تعظيمًا له . فقال النبيُّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ : نحنُ أَوْلى بموسى مِنكُم . فأَمرَ بصومِه ( صحيح مسلم)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন দেখলেন ইহুদীরা মুহাররামের ১০ তারিখে রোযা রাখে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কেন রোযা রাখছো? তারা বলল এ দিনে আল্লাহ মূসা (আ.)-এর কাওমকে মুক্তি দেন এবং ফেরআউনকে তার বাহিনীসহ ধ্বংস করেন। আমরা এর সম্মান হিসেবে রোযা রাখি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের থেকে মূসার বেশি নিকটবর্তী। সুতরাং তিনি সবাইকে আশুরায় রোযা রাখার আদেশ দিলেন। (মুসলিম)
তখন আশুরার দিন রোযা রাখলে ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় সাহাবীদের এমন কথার পরিপ্রেক্ষিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি সুন্দর সমাধান দেন;
عن عبدالله بن عباس قال حين صام النبي صلى الله عليه وسلم يوم عاشوراء وأمرنا بصيامه قالوا يا رسول اللهِ إنه يوم تعظمه اليهود والنصارى فقال رسول اللهِ صلى الله عليه وسلم فإذا كان العام المقبل صمنا يوم التاسع فلم يأت العام المقبل حتى توفي رسول اللهِ صلى الله عليه وسلم( أبو داود)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখলেন এবং আমাদেরকেও রাখতে বললেন সাহাবীগণ বললেন হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এই দিনকে তো ইহুদী ও নাসারারা সম্মান করে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন যদি আমি আগামি বছর বেঁচে থাকি তাহলে আশুরার ৯ম দিনে ও রোযা রাখবো (ইহুদী নাসারা দের সাথে পার্থক্য করতে)। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী আশুরা পাননি, এর আগেই এ ধরা ত্যাগ করেন। (আবূ দাউদ)
এ হাদীসের উপর ভিত্তি করে উলামায়ে কেরাম এ ব্যপারে একমত যে আশুরায় একটি রোজা রাখা মাকরুহ। ভালো হয় ৯ ও ১০ মুহররম রোযা রাখলে। সেটা সম্ভব না হলে ১০ ও ১১ মুহররম রাখলেও চলবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) অন্য একটি হাদীসে বলেন:
ما رأيتُ النبيَّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم يتحرَّى صيامَ يومٍ فضَّلَه على غيرِه إلا هذا اليومَ، يومَ عاشوراءَ، وهذا الشهرَ، يعني شهرَ رمضانَ (صحيح البخاري)
আশুরার রোযা ছাড়া অন্য কোন রোযার ব্যাপারে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এতো মনোযোগী হতে দেখিনি ।আর রামাদ্বান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে এই মাস থেকে বেশি রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারী)
অন্য এক হাদীসে এসেছে:
عن حفصة بنت عمرقالة أربعٌ لم يَكُن يدعُهُنَّ النَّبيُّ صلَّى اللَّهُ عليهِ وسلَّمَ : صيامَ عاشورا ، والعَشرَ ، وثلاثةَ أيَّامٍ مِن كلِّ شهرٍ ورَكعتَينِ قبلَ الغداةِ (النسائي)
উম্মুল মু‘মিনিন হযরত হাফছা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৪টি আমল কখনো ত্যাগ করতে দেখিনি; ১. আশুরার রোযা ২. যিলহজ্বের ১০ দিনের রোযা ৩. প্রতিমাসে তিন দিন রোযা ৪. আর ফযরের দুই রাকআত সুন্নত নামায। (নাসাঈ)।
আশুরার দিনে দান সদকা করাঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন আশুরার দিন যে ব্যক্তি পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তার পরিবারকে সারা বছর ভালো খাওয়াবেন।(মাকাসিদ আল হাসানাহ)
সুতরাং এসব আলোচনার উপসংহারে বলতে পারি আশুরা উপলক্ষে আমরা সব রকমের উত্তম আমল করবো। রোযা রাখবো, বেশি বেশি নামায আদায় করবো, দুরুদ পাঠ করবো, বেশি বেশি দান সাদকা করবো। আর যেহেতু এ দিনে আহলে বায়‘আতের বহু সংখ্যক সদস্য শাহাদাতবরণ করেন যাদের মাঝে মা ফাতিমা (রা.) হযরত হাসান হোসাইন (রা.)-এর সন্তানরা ছিলেন সেহেতু যাবতীয় নেক আমল তাদের রুহের উদ্দেশ্যে পেশ করবো। তাদের ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করবো। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আহলে বায়‘আত আর সালীহীনদের ওসীলা নিয়ে দু‘আ করা সৎকর্মশীলদের নিদর্শন।
আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসাঃ
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হাসান (রা.) কে কাঁধে নিয়েছিলেন । তখন একজন সাহাবী বললেন, হে বালক! অনেক দামী বাহন পেয়েছো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরোহীর দামও তো কম নয়। এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাতিগনের প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করা যায়। আমরা কেন আহলে বায়‘আতকেব ভালোবাসবো, এটা আল্লাহর নিয়ম।
পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফ এ মূসা (আ.) এবং খিজির (আ.) এর যে ঘটনা বর্ণিত আছে তাতে দেখা যায় তারা গ্রামবাসীর অসদাচরণ এরপরও সে গ্রামের একটি দেয়াল মেরামতে লেগে গেলেন। আল্লাহ বলেন সে দেয়ালের নিচে তিনি দুই জন এতিম বালকের সম্পদ রক্ষা করছিলেন যাদের পূর্ব পূরুষ সৎকর্মশীল ছিলেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে যে সৎকর্মশীল পূর্বপূরুষের কথা বলা হচ্ছে তিনি এই এতীম বালকদের সাত পুরুষ আগে ছিলেন। তাহলে আল্লাহ যদি সাত পূরুষ পূর্বের সৎকর্মশীল এর জন্য এতীমের মাল রক্ষা করতে পারেন, তাহলে আল্লাহর হাবীব, যার জন্য এ গোটা ভূ-খন্ডের সৃষ্টি আমাদের আ‘কা ও মাওলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যারা বংশধর তাদের জন্য এ উম্মতের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
সে আহলে বায়‘আতের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ধারণ করল, তাদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করল সেই এযিদকে অথবা তার সাঙ্গপাঙ্গদের কে যারা রক্ষা করতে চায়, কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনাকে যারা রাজনৈতিক যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতে চায় তাদের সাথে আমরা একমত হতে পারিনা।
অন্য হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
حسين مني وأنا من حسين( ابن ماجه)
হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে। (ইবন মাজাহ)
এখানে আরেকটি কথা বলা যায় যে, যদি কুরআন-হাদীসে হোসাইন (রা.) ও আহলে বায়তের মর্যাদা মাহাত্ম নিয়ে কিছু বলা নাও থাকতো তারপরও নিরপেক্ষ ভাবে কেউ যদি কারবালার নির্মমতার ইতিহাস পাঠ করে তবে তার চোখ থেকে পানি পড়ার কথা, ইয়াযিদ ও তার বাহিনীকে ধিক্কার জানানোর কথা। শুধু ঈমানদার বা নবী প্রেমিক নয় যে কোন মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষেরই এরুপ অনুভূতি হবে। যারা এতো নির্মমতা এতো অন্যায়ের পরও ইয়াযিদ এর পক্ষাবলম্বন করে নিশ্চিতভাবেই তারা পথভ্রষ্ট।
আমরা তাদের থেকে দুরে থাকবো। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে আহলে বায়‘আত কে স্মরণ করবো, আমরা যে তাদের কে ভালোবসি তা প্রমান করবো।
হাদীস শরীফে :
عن أبي سعيد الخدري قال قال: رسول الله صلى الله عليه وسلم: الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة
হযরত আবি সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন হাসান ও হোসাইন (রা.) জান্নাতের যুবকদের সরদার। (তিরমিযী) সুতরাং সরদারদের সাথে ভালোবাসা না রেখে জান্নাতী হওয়ার আশা করা হবে বোকামি।
আল্লাহ পাক আমাদের কে আহলে বায়তের মহব্বত দিয়ে ভরপুর করুন এবং ইমাম হোসাইন রাঃ এর আদর্শ বুকে লালন করে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে ও পাপিষ্ঠ ইয়াযিদের নব্য বংশধরের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার তৌফিক দান করুন। (আমিন।)