বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ : খাও না খাও কিস্তির টেকা দেও
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৭:৫০,অপরাহ্ন ২৯ জুলাই ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ। গত ১৬ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যায় জেলার কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। ঘরবাড়ি, জমির ফসল, গবাদি পশু সব ভেসে গেছে। দীর্ঘ এক মাসের বেশি আশ্রয়কেন্দ্রে কাটিয়ে সম্প্রতি অনেকেই ভিটায় ফিরেছেন। পরিবারের দু’মুঠো খাবার জোগাড়ে হিমশিম অবস্থার মধ্যেই তাঁদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে এনজিওর ঋণের কিস্তি। খাও না খাও, কিস্তি দিতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বন্যাদুর্গত এলাকায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখার নির্দেশ দিলেও কেউই মানছে না। এনজিওকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাপ দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে অনেকে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্ত হচ্ছেন। সেখান থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আরেক বিপদে পড়ছেন।
গত সোমবার সরেজমিনে সুনামগঞ্জ শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কোরবাননগর ইউনিয়নের হাছনবাহার গ্রামে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। বাবাকে দাফন করে কিস্তি দিতে ছুটতে হয়েছে, এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনাও পাওয়া গেছে। এই গ্রামে ছোট-বড় আড়াইশ পরিবারের বসবাস। বন্যায় সবারই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুই শতাধিক পরিবার বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। কিছু পরিবার তিন-চারটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু বন্যায় সব হারিয়ে এখন কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
তাঁরা জানিয়েছেন, ঘরে খাবার না থাকলেও কিস্তি মাফ নেই।
গ্রামের মৃত আব্দুল ওয়াহাবের মেয়ে মনিরা বেগম যেমনটি বলছিলেন, আমার আব্বা কামকাজ কইরা খাইন, এনজিও থাকি ঋণ আনছিলা। পরে অসুখও পড়ি গেছইন, আম্মায় যোগালোর (মিস্ত্রির সহযোগী) কাম কইরা-কইরা কিস্তি দিছইন। শনিবারে আব্বা মারা গেছইন, তারারে (এনজিওকর্মী) গাঁওয়ের মাইনসে ফোনে জানাইছইন। আজকে (সোমবার) কিস্তির স্যারে আইয়া ফোন দিছইন। বই লইয়া গেলাম, তাইন কইন ৫ কিস্তির টেকা বকেয়া, টেকা তো দেওয়া লাগব। আমি পরে সঞ্চয়ের টেকা থাকি কিস্তির টেকা কাটাইয়া দিয়া হিসাব শেষ কইরা আইছি। মরো আর বাঁচো, কিস্তি দিতায় অইবায়।
গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী হামিদা বেগম বলেন, আমার স্বামীয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করইন, বন্যার আগে যার কাম করছিলা, তার কাম শেষ অইবার আগেই (নির্মাণাধীন) ঢলে আইয়া ঘর ভাঙ্গিলিছে। মাজনে (ঘরের মালিক) কইন কের (কিসের) টেকা, ঘর ভাইঙ্গা গেল গি। অখন লেবার আইয়া টেকা চায়। টেকা কই থাকি দিতা, নিজেরার ঘরদুয়ার ভাইসসা গেছেগি, থাকি বাপের (বাবার) বাড়ি, বন্যার আগেঔ ঘর বানাইবার লাগি গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাক থাকি ঋণ আনছিলাম। অখন কামকাজ নাই, ঘরের ধান-পানও নষ্ট। ঋণ কইরা আইন্না খায়রাম, খাওয়া-দাওয়া আর কিস্তির লাগি ১৬ হাজার টেকা হাওলাতি ঋণ, আর এনজিওর কিস্তির লাগি ২০ হাজার টেকা সুদে আনছি। অখন সুদ দিতাম কিলা, আর কিস্তিঔ দিতাম কিলা। হাঁটতে গেলে পাওঔ চলের না।
কিস্তি শোধে এনজিওর কড়াকড়ি নিয়ে গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ নূর জাহান বেগম বলেন, আমি কারও থেকে ঋণ নেইনি। ওমর ফারুক নামে এক ঋণ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি- তাঁরা এত পাষাণ কেন? পরিবারের অভিভাবক মারা গেছে। ঘরে খাবার নেই। অথচ এক দিন না যেতেই ওই পরিবারের লোকজনকে কিস্তির জন্য ডেকেছে। কয়েক দিন সময় দিলে কী এমন হতো?
হাছনবাহার গ্রামের মোসাদ্দেক আলী ও হেপি বেগম জানান, কিস্তি নেওয়ার জন্য সব এনজিওর লোকই বাড়ি এসে বসে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএসসহ বিভিন্ন এনজিওকর্মীদের সঙ্গে গ্রাহকদের কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হচ্ছে। গ্রামবাসী বলেছে, তাঁদের ঘরে খাবার নেই, শিশুরা পর্যন্ত খেতে পারছে না, ঋণ কীভাবে দেবে? জবাবে এনজিওগুলো সাফ জানিয়েছে, খাও না খাও কিছুই যায় আসে না। ঋণের টাকা আগে দেওয়া লাগবে।
এক পর্যায়ে গ্রামের বন্দেবাড়ী এলাকায় গিয়ে এই প্রতিবেদক বিষণ্ন মনে অন্তত ২০ নারীকে দেখতে পান। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে কিস্তির টাকা ও বই। সবাই আশার ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুককে ঘিরে দাঁড়িয়ে। সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে ওমর ফারুক উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, আজ কিস্তি দিতে হবে না। যারা আমাদের দেওয়া সহায়তার এক হাজার টাকা পাননি, তাঁরা ছাড়া অন্যরা চলে যান। এখানে উপস্থিত হাজেরা বেগম, রাবিয়া বেগম, বাহার বেগম, সাহানারা বেগম, রাহেলা বেগম ও মাসুদা বেগম জানান, তাগাদা দিয়ে তাঁদের থেকে কিস্তির টাকা নিয়েছেন ওমর ফারুক।
আশার ঋণ কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, আমরা কিস্তি আদায় করছি না। ঘর মেরামতে অনেকে ঋণ চেয়েছেন। তাঁদের দু-একটা কিস্তি বকেয়া, সেগুলো রেগুলার করে নতুন ঋণ দিচ্ছি। এ ছাড়া আমাদের ঋণ গ্রহীতাদের এক হাজার টাকা করে ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো দিতেই অনেককে ডাকা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি আদায় স্থগিত রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকও আপাতত ঋণ আদায় স্থগিত রাখতে সার্কুলার দিয়েছে। গত রোববার জেলা কৃষিঋণ কমিটির সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধির সামনে তাঁরা (এনজিও ও ব্যাংকের প্রতিনিধি) সার্কুলার মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন। জোর দিয়ে বলেন, তাঁরা ঋণ আদায় করছেন না।
তিনি বলেন, বাস্তবতা হলো- আমি নিজে ঋণ আদায়ের বিষয়ে কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি। পরে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে এনজিওগুলো বলেছে, স্বেচ্ছায় কেউ ঋণ দিতে চাইলে নিচ্ছে, কাউকে কিস্তির জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে না। নতুন করে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোকে চিঠি পাঠাতে বাধ্য হবো।সুত্র-সমকাল