জ্বালানি মজুত ঝুঁকিতে
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৭:০৯,অপরাহ্ন ২৭ জুলাই ২০২২
অব্যাহতভাবে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় দেশের জ্বালানি মজুত ঝুঁকিতে পড়েছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। ডলারের দাম আরও বাড়লে জ্বালানি তেল আমদানিতে বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আপাতত জ্বালানি সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জ্বালানি সাশ্রয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর একটি পাম্পে জ্বালানি সরবরাহে সীমা নির্ধারণ করে নোটিশ টানিয়েছে। এতে মোটরসাইকেলে ৪০০ টাকা এবং গাড়িতে ৩ হাজার টাকার বেশি জ্বালানি দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও রাজধানীর অন্যান্য পাম্পে স্বাভাবিকভাবেই তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে।
সরবরাহে লাগাম টানায় মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের কয়েকটি সিএনজি পাম্প স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এসব স্টেশনের মাসিক সরবরাহ লক্ষ্যমাত্রা শেষ হয়ে যাওয়ায় চলতি মাসে আর গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। এ কারণে এই দুই জেলায় সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ওদিকে বিপিসি সূত্র জানায়, মূলত ডলার সংকটে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে বিপিসি’র। সংস্থাটি বলছে এখন পর্যন্ত সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। তবে সামনের পরিস্থিতি নিয়ে তারা চিন্তিত।
বিপিসি’র কর্মকর্তারা জানান, দেশে ডিজেলের মজুত ক্ষমতা ৬ লাখ টনের বেশি। অকটেন মজুতের ক্ষমতা ৪৬ হাজার টন, পেট্রোল ৩২ হাজার টন, কেরোসিন ৪২ হাজার টন। আর ফার্নেস অয়েলের মজুত রাখা যায় ১ লাখ ৫০ হাজার টন। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন পরিচালক (বিপণন) ও যুগ্ম সচিব অনুপম বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, বিপিসি’র হাতে এখন ডিজেল আছে ৩৪ থেকে ৩৫ দিনের। অকটেন ও পেট্রোল পর্যাপ্ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে জ্বালানি তেলের মজুত ও সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। নিয়মিত এলসি খোলা হচ্ছে।
জ্বালানি মজুতের বিষয়ে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত ৬ মাসের তেল মজুত থাকলে নিরাপদ মনে করা হয়। তবে তেল বেশি দিন মজুত করলে বেশি খরচ গুনতে হয়। অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, এখন সমস্যা হলো ডলার সংকট। বিপিসি বলেছে, তাদের ৪৫ দিনের মজুত আছে তেল। আর নতুন করে তেল আমদানির জন্য যখন এলসি খুলতে ব্যাংকে গেল, তখন ব্যাংক বলেছে তাদের ডলার নেই। ফলে ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও বিল পরিশোধে জটিলতায় পড়ে বিপিসি।
বিপিসি সূত্র জানায়, ডিজেলের অধিকাংশই ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে। এ ছাড়া কৃষি, সেচ ও বিদ্যুৎ খাতেও ডিজেল ব্যবহৃত হয়। বছরে তাদের মোট জ্বালানি সরবরাহের ৭৩ শতাংশই ডিজেল। বছরে ৪৫ থেকে ৪৬ লাখ টন ডিজেল বিক্রি করে বিপিসি। ডিজেল ছাড়াও বিপিসি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল, পরিবহনের জন্য অকটেন, উড়োজাহাজের জন্য জেট ফুয়েল এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। সব মিলিয়ে দেশের মোট জ্বালানি তেলের ৬৩ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাত ৭ ও বিদ্যুৎ খাত ব্যবহার করে ১০ শতাংশ।
বিপিসি’র দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফার্নেস তেলের ৮০ থেকে ৯০ দিনের মজুত আছে এখন। অকটেন ও পেট্রোল আছে ২৫ দিনের। আর জেট ফুয়েলের মজুত দিয়ে চালানো যাবে ৩৮ থেকে ৪৫ দিন। প্রতি মাসেই সব মিলিয়ে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। বছরে সব মিলিয়ে ৬০ লাখ টন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ৪৫ লাখ টনই থাকে ডিজেল।
এ ছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই নিজেরা ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানি করে থাকে। তাই বেসরকারি খাতেও জ্বালানি তেলের মজুত আছে।
বিপিসি সূত্র জানায়. জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি আমদানি ঋণপত্র খুলতে হয়। ডলারের ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে প্রায়ই অপারগতা প্রকাশ করছে। তবে জ্বালানি তেল আমদানি করতে বিদেশি সরবরাহকারীদের বিল পরিশোধ ও ঋণপত্র খোলা নিয়ে বিপিসি’র জটিলতা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
মৌলভীবাজারে গ্যাসের জন্য হাহাকার, চরম দুর্ভোগ
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে জানান, সিএনজি অটোরিকশা, গণপরিবহন ও প্রাইভেট যানবাহনের গ্যাসহীনতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এক উপজেলার গাড়ি গ্যাস নিতে অন্য উপজেলায় ছুটছে। তারপরও রাত দিন দীর্ঘ সারিতে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পরও মিলছে না গ্যাস। গেল কয়েকদিন থেকে এ সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। জেলাজুড়ে এর বিরূপ প্রভাবও পড়ছে সর্বক্ষেত্রে। জেলার অন্যতম ৩টি সিএনজি গ্যাস স্টেশন সরবরাহ বন্ধ করায় এমন দুর্ভোগে পড়েছেন পরিবহন চালক, মালিক ও যাত্রীরা। জেলা সদরে অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে ও চিকিৎসা নিতে আসা লোকজনও পড়ছেন এমন চরম বিড়ম্বনায়।
জানা গেছে, জালালাবাদ গ্যাস থেকে প্রাপ্ত মাসের নির্ধারিত বরাদ্দ শেষ হওয়ায় মৌলভীবাজারের ৩টি সিএনজি গ্যাস স্টেশনে সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। জেলার অন্য স্টেশনগুলোরও বরাদ্দ শেষ হওয়ার উপক্রম। যানবাহনে সিএনজি গ্যাস ফিলিং করতে না পেরে দুর্ভোগ ও জ্বালানি সংকটে পড়েছে জেলার বিভিন্ন রোডে চলাচলকারী কয়েক হাজার যানবাহন। গত কয়েক দিন থেকে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলায় প্রধান তিনটি সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। জালালাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসের গ্যাস বরাদ্দের পরিমাণ শেষ হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকায় মেসার্স সাজ্জাদুর রহমান সিএনজি ফিলিং স্টেশন, শমসেরনগর সড়কের এমএফ সিএনজি ফিলিং স্টেশন এবং রাজনগর উপজেলার ডেলটা সিএনজি অ্যান্ড ফিলিং স্টেশনে প্রতি মাসের বরাদ্দ মাস শেষ হওয়ায় আগেই ফুরিয়ে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
সিএনজি অ্যান্ড ফিলিং স্টেশন মালিক ও ভুক্তভোগীরা জানান, শুধুমাত্র মৌলভীবাজারের স্টেশনগুলোর সঙ্গে কর্তৃপক্ষ এমন কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের স্টেশনগুলো ঠিকই অতিরিক্ত বরাদ্দ পাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত লোড তাদেরকে মেনে চলতে হচ্ছে। দেশজুড়ে বিদ্যুতের মতো গ্যাসেরও চাহিদানুযায়ী সরবরাহ সীমিত করা হচ্ছে। সরবরাহ বন্ধকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দ শেষ হয়েছে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে তারা সতর্ক করে দেন যাতে বরাদ্দের ভেতরে তারা সরবরাহ করেন। গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে জেলা ভিত্তিক আলাদাভাবে কোনো বৈষম্য বা উদারতা নেই এমন অভিযোগ ঠিক নয় সব ক্রেতার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমান রয়েছে বলে তারা জানান। বলেন, সিলেট বিভাগের অন্য জেলাগুলোর কয়েকটি সিএনজি স্টেশনের একই অবস্থা। দু’একদিনের মধ্যে বরাদ্দ শেষ হওয়ায় তাদের স্টেশনও বন্ধ হয়ে যাবে।
মৌলভীবাজারে চাহিদানুযায়ী বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হবে কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, বর্তমানে সরকার সর্বক্ষেত্রেই গ্যাস সরবরাহ সীমিত করছেন। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। তবে চলতি মাস শেষ হলে পূর্বের ন্যায় নির্দিষ্ট বরাদ্ধের গ্যাস বন্ধ থাকা ওই প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ পাবে। স্টেশন মালিকরা জানান চাহিদা বাড়ায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন থেকে বারবার আবেদন করার পরও বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না জালালাবাদ কর্তৃপক্ষ। তাই স্থানীয় চাহিদা নিবারণ করা যাচ্ছে না।
জানা যায়, মেসার্স সাজ্জাদুর রহমান সিএনজি ফিলিং সেটশনটি ২০১২ সালে ১ লাখ ৬২ হাজার ২৪০ ঘন মিটার বরাদ্দ নিয়ে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ চালু করে। কিন্তু প্রতি বছরই যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় এই বরাদ্দে স্টেশন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তাদের দাবি। শমসেরনগর রোডের এমএফ সিএনজি ফিলিং স্টেশনটির বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ঘনমিটার। তাদের বরাদ্দের পরিমাণ শেষ হওয়ায় ২০শে জুলাই দুপুর থেকে তারাও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। রাজনগর উপজেলার ডেলটা সিএনজি অ্যান্ড ফিলিং স্টেশনটির বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ২৪০ ঘনমিটার। তাদের বরাদ্দের পরিমাণ শেষ হওয়ায় ২২শে জুলাই সকাল ১১টা থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
সর্বশেষ শ্রীমঙ্গলের কালাপুর এলাকার মেরী গোল্ড ফিলিং স্টেশন বন্ধ করে দেয় জালালাবাদ কর্তৃপক্ষ। এই তিনটি স্টেশন ছাড়াও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল রোডে মাজ সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও রহমান সিএনজি ফিলিং স্টেশন চালু রয়েছে। কিন্তু ওই দু’টি স্টেশন যানবাহনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে গ্যাস নিতে ছুটে আসছেন কুলাউড়ার স্টেশনগুলোতে। ওই স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ লাইনে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কেউ পাচ্ছেন। আবার কেউ পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ দুর্ভোগ্রস্তদের। চালু থাকা স্টেশনগুলোর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে বলে সতর্ক করছেন সংশ্লিষ্টরা।