‘ঈদ তো ইস্কুলে করমু যামু কই’
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৫১:১৯,অপরাহ্ন ০৯ জুলাই ২০২২
বাড়িঘরে পানি। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ। ঈদ তাদের স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রেই করতে হবে। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার চাপ। মুখে হাসি নেই। কাজ-কর্ম নেই। সবখানেই পানি। এমন অবস্থায় কেউ দিলে খায়, নতুবা অভুক্তই থাকতে হচ্ছে তাদের। এমন করুন পরিণতে এবার ঈদ যাপন করতে যাচ্ছে সিলেটের মানুষ। যাদের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে তাদের চোখে-মুখেও দুশ্চিন্তার চাপ।
ঘর, দুয়ারের অবস্থা ভালো নেই। কেউ সবেমাত্র বাড়ি উঠেছেন। খাবার সংকট। ঈদের প্রস্তুতিও নেই। গতকাল বিকাল ৩ টা। শহর লাগোয়া এলাকা সিলাম। নগরের শেষ, ইউনিয়নের শুরু। এমন এক জনপদের বিদ্যাপিঠ সিলাম ইসলামিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদ্রাসা। ২৫-২৬ দিনে আশ্রিতরা বাড়িঘর গড়ে তুলেছেন এই কেন্দ্র। ওখানকার বাসিন্দা ফাতিমা বেগম। প্রায় ২৫ দিন আগে রিকশাচালক স্বামী রিপন মিয়া, চার সন্তান নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। এখনো আছেন ওখানে। ফাতেমা সিলাম বাজারে কটন মিয়ার কলোনির বাসিন্দা। ফাতেমা জানালেন- ‘ঈদ তো ইস্কুলেই করমু, যাবো কই।
যাওয়ার তো জায়গা নেই। ঘর থেকে পানি নামেনি। আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ খাবার দিলে খাই। নতুবা চিড়া-মুড়ি খেয়ে দিন কাটাই।’ আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা সম্পর্কে ফাতেমা জানান- ‘কেন্দ্রের বারান্দা পর্যন্ত পানি উঠেছিলো। এখন নামছে। এতে কিছুটা স্বস্তি। তবে- পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’ কোলে থাকা শিশু সুজাতাকে দেখিয়ে ফাতেমা জানান- ‘তারও ডায়রিয়া। একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলেও অসুস্থ। কী করবেন- বুঝে উঠতে পারছেন না।’ ফাতেমার মতো অসহায় ছমরু মিয়া ও সাত্তার আহমদও। মানবজমিনকে তারা জানিয়েছেন- ‘আজ প্রায় ২০ দিন হলো আশ্রয়কেন্দ্রে। পরিবার নিয়ে অসহায়। গোটা এলাকা পানির নিচে। কেউ দিলে খান, নতুবা বসে থাকেন। এই অবস্থায় এবারের ঈদ তাদের কাছে উৎসবের নয়। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যেতে পারেননি।’ এই আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ২০টি পরিবার বসবাস করছেন।
তাদের সবার অবস্থাও একই। এদিকে- স্থানীয়দের পক্ষ থেকে প্রতিদিন আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দাদের খাবার দেয়া হচ্ছে। বিত্তবানরা রান্না করে নিয়ে আসেন। তারা নিজেরাই সবার কাছে খাবার বণ্টন করেন। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন- আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজনকে ঈদের আনন্দে শামিল করতে তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। যারা কোরবানি দেবেন তারা আশ্রয়কেন্দ্রে মাংস পৌঁছে দেবেন। তবে- এবার বাড়িঘরে পানি থাকায় অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না বলে জানান তারা। দক্ষিণ সুরমার তেলীপাড়া গ্রামে বাড়ি দলিল লেখক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা ফরিদ আহমদের। তিনি জানালেন- ‘এখন পানি নামছে, তবে তা ধীর গতিতে। এ কারণে মানুষের মধ্যে দুর্ভোগ বেশি। এবার পানিবন্দি অবস্থায় সবাই ঈদ পালন করতে হবে।’ ফরিদ জানান- ‘পানি নামছে এক সুতো এক সুতো করে। আবার বৃষ্টি দিলে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে যারা বাড়িঘর ছেড়েছিলেন তারা এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি।’
স্থানীয় কলাতল এলাকার নবারুণ উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল ১৭টি পরিবার। গতকাল বিকাল পর্যন্ত সেখানে ছিল ১১টি পরিবার। ঘর থেকে পানি নামায় একটি পরিবার বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যরা স্কুলেই ঈদ উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। মঞ্জলাল গ্রামের সালেক আহমদ জানিয়েছেন- ‘পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। ঈদও এখানে করতে হবে। পানি নামার লক্ষণ নেই। স্থির হয়ে আছে পানি।’ তিনি জানান- ‘আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করে খাবার খাচ্ছেন। ঈদের দিন কেউ কিছু দিলে খাবেন, নতুবা এভাবেই থাকবেন বলে জানান তিনি।’ চর মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা রিনা বেগম জানিয়েছেন- ‘এভাবে ঈদ পালন করবো, ভাবিনি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছি; তারা সবাই মিলেমিশে ঈদ উদ্যাপন করবো বলে জানান তিনি।’ সিলাম ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. মঈনুল ইসলাম জানিয়েছেন- ‘এলাকায় যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন কিংবা বাড়িতে আছেন- সবাই পানিবন্দি। সবার অবস্থা একই। রাস্তাঘাট থেকে এখনো পানি নামেনি। ফলে এখনো দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে তার এলাকার মানুষ। মানুষ খাবার পাচ্ছে, কিন্তু পানির কারণে কেউ-ই স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদ্যাপন করতে পারছেন না।’
তিনি জানান- ‘যারা এলাকার বিত্তশালী মানুষ, তারা কোরবানি দেবেন। পানিবন্দি মানুষ যাতে কম হলেও একটু কোরবানির মাংস পায়, সে প্রচেষ্টা আমাদের রয়েছে। আমরা অসহায় মানুষদের মধ্যে কোরবানি মাংস বিলিয়ে দেয়ার আহ্বান ইতিমধ্যে জানিয়েছি। আবার অনেকেই সেমাই, পিঠাসহ নানা কিছু বানভাসি মানুষদের মধ্যে বিতরণ করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’ এদিকে- সুরমা-কুশিয়ারা দুটো নদীর পানির তোড়ে ডুবে যায় দক্ষিণ সুরমা। সুরমার পর কুশিয়ারার পানিতে তলিয়ে গেছে সব ইউনিয়ন। উপজেলার ৭০ ভাগ এলাকাই পানির নিচে তলিয়ে আছে। সুরমা পানি না কমায় দক্ষিণ সুরমার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। উপজেলা পিআইও বাধন কান্তি সরকার জানিয়েছেন- ‘দক্ষিণ সুরমার ৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। অর্ধেক মানুষ বাড়িঘরে ফিরেছেন। আরও অর্ধেক রয়েছেন ফেরার অপেক্ষায়। সরকার থেকে তাদের খাবার দেয়া হচ্ছে।’ তিনি জানান- ‘ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬০টি পরিবারকে বাড়িঘর মেরামতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। যেখানে ত্রাণের প্রয়োজন সেখানে সরকারের তহবিল থেকে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।’