সিলেটে বন্যা: আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদ কাটানোর প্রস্তুতি
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:০৫:২৫,অপরাহ্ন ০৮ জুলাই ২০২২
‘দম ধরে আছে পানি। নড়ছে না। ঘরে পানি। যাওয়ার জায়গা নেই। এবার হয়তো ঈদ আশ্রয়কেন্দ্রে করতে হবে। কিছু করার নেই। বেঁচে যে আছি এটাই শুকরিয়া’- কথাগুলো বলছিলেন বালাগঞ্জের আদিত্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা ছমরু মিয়া। ১০ জনের পরিবার। সবাইকে নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে বসবাস করছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। আদিত্যপুরে তার বাড়ি।
জানালেন- ‘ঘরে এখনো পানি। কিছুটা কমেছিল। মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে ফের পানি বেড়েছে। গত দু’দিন ধরে বাড়ছে না, কমছেও না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।’ শুধু ছমরু মিয়া নয়; আদিত্যপুর আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো রয়েছে ৭-৮টি পরিবার। ঘরে পানি থাকায় তারা বাড়ি ফিরতে পারছে না। একই উপজেলার আরেকটি আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে চরসুবিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল। এখানেও রয়েছে কয়েকটি পরিবার। ঘর থেকে পানি নামায় ৪-৫টি পরিবার বাড়ি গেলেও অনেকেই রয়েছেন এ আশ্রয়কেন্দ্রে। ওই কেন্দ্রের বাসিন্দা খালেদ মিয়া জানিয়েছেন- ‘কী আর করার। পানি না নামলে তো বাড়ি ফিরতে পারবো না।
পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রেই আছি। ওখানেই ঈদ করবো। যাওয়ার তো আর জায়গা নেই। মানুষ যা দেয় তাই খাই। কাজকর্মও নেই। ৫ জনের পরিবার দুই সপ্তাহ ধরে পড়ে আছি এখানে।’ ১৬ই জুন সিলেটে আঘাত হেনেছিলো প্রলয়ঙ্করী উজানের ঢল। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। ঘরবাড়ি ছেড়ে আড়াই লাখ মানুষ এসে অবস্থান নেন সাড়ে ৬শ’ আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কিছুটা কমেছে। এ কারণে সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, বিশ্বনাথ ও সিলেট সদরের বেশির ভাগ আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষজন বাড়ি ফিরেছে। নিচু এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখনো মানুষ রয়েছে। তবে- বেশি খারাপ অবস্থা কুশিয়ারা অববাহিকার ৬টি উপজেলার। এগুলো হচ্ছে; জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর। ওই ৬ উপজেলার ভাটির জনপদ ওসমানীনগরের সাদিপুর ইউনিয়ন। এখনো পানিতে নিমজ্জিত ইউনিয়নের ৭০ ভাগ এলাকা।
উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই কলারাইয়ের এহিয়া চৌধুরী আশ্রয়কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে এখনো রয়েছে ১০-১২টি পরিবার। স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহীন আহমদ জানিয়েছেন- ‘কলারাই, মুতিয়ারগাঁও সহ কয়েকটি গ্রামের মানুষের বাড়িঘরে পানি। ওদের তো যাওয়ার জায়গা নেই। এ কারণে তারা এখনো আশ্রয়কেন্দ্রেই রয়েছে। পানি নামছে না। ফলে তাদের বাড়িফেরা অনিশ্চিত। আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদ পালন করতে হবে।’ তিনি জানান, ‘ভাটি এলাকা মোবারকপুর, হলিমপুর, গাভুরটিকি, চাতলপাড়, কালনীচর, মোকামপাড়া, সুন্দিখলা সহ কয়েকটি এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে। পানি নামলেও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারবে না বলে জানান তিনি।’ সাদিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেদ আহমদ মুছা জানিয়েছেন- ‘তার ইউনিয়ন হচ্ছে ৬ উপজেলার ভাটির ইউনিয়ন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছাড়া সব সড়কই পানিতে তলিয়ে গেছে। এখনো ৭০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। তার ইউনিয়নে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল।
এর মধ্যে দুটি কেন্দ্রের মানুষজন বাড়ি ফিরলেও ২৮টি কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে। বাড়িঘরে পানি থাকার কারণে এসব মানুষ বাড়ি ফিরতে পারছে না বলে জানান তিনি।’ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদর এখনো পানি নিচে। সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে তিন কিলোমিটার এলাকা কোমর পানিতে নিমজ্জিত। ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। খোদ উপজেলা সদরেই কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা সদরে কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়, ফরিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ছত্তিশ গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো বসবাস করছে মানুষ। ওই তিনটি আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ২২শে জুনের পর তারা এসে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন। এখনো আছেন। পানি কমলে বাড়ি ফিরবেন। না কমলে আশ্রয়কেন্দ্রেই বসবাস করতে হবে। তারা জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে এখন খাবার পাচ্ছেন। মানুষজন এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা রান্না করে খাচ্ছেন। সিলেটের জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা পল্লব হোম দাস গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘সিলেটের আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো অনেক মানুষ রয়েছে। তাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২২ হাজার মানুষ বসবাস করছে।
অনেকেই বাড়ি ফিরেছেন। যাদের বাড়িঘরে এখনো পানি রয়েছে তারা আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়েননি। আশ্রয়কেন্দ্রে যারা রয়েছেন তাদের কাছে সরকারি ত্রাণ আগেই পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।’ এদিকে বন্যার্ত এলাকায় নানা দুর্ভোগে রয়েছে মানুষ। পানি থাকার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। বালাগঞ্জ-তাজপুর সড়কে পানি রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই সড়ক। ফলে এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে রয়েছে। ঈদ ঘনিয়ে এলেও কোনো প্রস্তুতি নেই বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরে। একই অবস্থা ফেঞ্চুগঞ্জেও। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে- এখনো কানাইঘাটে সুরমা, জকিগঞ্জের অমলসীদ, বিয়ানীবাজারের শ্যাওলা ও ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার উপরে রয়েছে। প্রতিদিন ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার করে পানি কমে। আবার বৃষ্টি হলে পানি বেড়ে যায়। পাউবো’র কর্মকর্তাদের মতে- সিলেটের ভাটি হচ্ছে সুনামগঞ্জ। ওই এলাকা দিয়ে সিলেট জেলার পানি নামে। সুনামগঞ্জেও বন্যার পানি নামছে না। যার ফলে সিলেটের পানিও অপসারিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।