সিলেটে প্রথম ঢলে ফসল, এবার গেল বাড়ি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১৬:১১,অপরাহ্ন ০৬ জুলাই ২০২২
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ধলাইয়ের তীরবর্তী চাঁনপুর গ্রাম। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের নিকটবর্তী গ্রাম। মাঝখানে কেবল একটি নদী নামে নদী হলেও আদতে সেটি একটি বড় খাল। একটা উপজেলা সদরের নিকটবর্তী কোনো জনপদ এমন অবহেলিত ও দৈন্য হতে পারে; তা চাঁনপুর না এলে কেউ বিশ্বাস করবে না। প্রায় আড়াইশ’ পরিবারের বসবাস এ গ্রামে। আগে আরও বেশি পরিবার ছিল। বন্যা ও উজানের ঢলে ভিটেমাটি হারিয়ে অনেকে ছেড়েছে গ্রাম। গ্রামের গাঁঘেষে চলা ধলাই নদীর ঢেউয়ের আঘাতে সৃষ্ট ভাঙনের শব্দে এখানকার রাতের নীরবতা ভাঙে। আশ্রয়হারা মানুষের আর্তনাদ এখানকার নৈমিত্তিক দৃশ্য। এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় নিঃস্ব হয়েছেন এ গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ।
আচমকা নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তলিয়ে যায় তাদের ভিটেমাটি। তারপর নদী গিলে খায় একে একে অর্ধশতাধিক বসতঘর, গরুর খামার ও খড়ের ঘর।
শতবর্ষী বৃক্ষসমেত বিস্তীর্ণ একটা মাঠ যেখানে শিশু-কিশোররা খেলা করতো, সেই খেলার মাঠও বিলীন হয়েছে নিমিষেই। বানের পানি নামলেও আশ্রয়হারা মানুষগুলো এখনো রয়ে গেছেন শিবিরে। সবাই যার যার ঘরে ফিরলেও চাঁনপুরে মানুষগুলো জানে না তাদের ফিরার ঠিকানা কোথায়? নির্মম নিয়তিই এ গ্রামের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গী বলে মন্তব্য করলেন এ গ্রামেরই শামসুল আলম। স্থানীয় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর তত্ত্বাবধায়ক শামসুল আলম বন্যার ধ্বংসলীলার মধ্যে কোনোক্রমে পরিবার নিয়ে নিরাপদে আসতে পারলেও ঘরের সব আসবাবপত্র ভেসে যায় ঢলের তোড়ে। শামসুল আলমের পুত্র এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে। বন্যার তাণ্ডবে দিশাহারা এ লোকটির মনে তবুও আনন্দ নেই। পরিজন নিয়ে অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছেন। চাঁদপুর গ্রামের মৌলা মিয়া, মুরশীদ আহমদ, আবদুর রহিম, ফাতেমা বেগম, রমজান আলী, আরজু মিয়া প্রত্যেকেই হারিয়েছেন নিজ নিজ বসতঘর।
পরিজন নিয়ে সবাই এখন উদ্বাস্তু। বসতঘরের ভাঙা টিনের চাল খুলেছিলেন নূরুল আমিন। তিনি জানান, প্রথম বারের বন্যা ফসল খেয়েছে আর এবার খেলো বাড়ি। সব হারিয়ে লোকটি এখন পরিজন নিয়ে দিশাহারা। বিধবা আমেনার একমাত্র সম্বল বসতঘরটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তিনটি প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে আমেনা ভবঘুরে জীবনযাপন করছেন। চাঁনপুর গ্রামের কল্পনা বেগম চারটি সন্তান নিয়ে এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। কারণ তার বসতঘরটি ভেসে গেছে ধলাই নদীর ঢেউয়ের তোড়ে। জামিন মিয়া, ছায়াদ আলী, আলিম মিয়া, নুবুর চাঁদ, কদর মিয়া, রাহাত মিয়া, শুকুর আলী, মনু আলীদেরও কপাল পুড়েছে সর্বনাশা বন্যায়। সহায় সম্বল ও বসতবাড়ি সব হারিয়ে এরা এখন শূন্য। গ্রামের কোলঘেঁষে ছিল খামার। সেখানকার বেশ কয়েকটি গরু ঢলের তোড়ে হারিয়ে যায়। গ্রামের অসংখ্য হাঁস, মুরগি ভেসে গেছে জলে। কৃষকের গোলাভর্তি ধান, সরিষা, বাদাম, কলাই সহ সরক্ষিত সব খাদ্যপণ্য ব্যাপক ভাবে বিনষ্ট হয়েছে পানিতে। কৃষক জয়নাল মিয়াকে এখানে ঢলের তাণ্ডবের দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে। অর্ধ বিধ্বস্ত ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তার অসহায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন।
বলেন- এবারের বন্যায় চাঁনপুর গ্রামের অর্ধেক গৃহস্থের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। নদী তীরের গ্রামের অবশিষ্ট ভিটায় মানুষ ঘর বাঁধতে সাহস পাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত এ মানুষগুলোর তাই প্রয়োজন নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং জানিয়েছেন, উপজেলা সদরের নিকটবর্তী হলেও চাঁনপুর গ্রাম মূলত একটা বিচ্ছিন্ন জনপদ। এবারের বন্যায় অন্যান্য এলাকার মতো এ গ্রামেও ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা তৈরি করেছি। কোম্পানীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবিদুর রহমান জানিয়েছেন, নদী ভাঙনের কবলে নিশ্চিহ্ন হওয়া চাঁনপুর গ্রাম রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে গ্রামের মানুষ ঢলের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেতো। স্থানীয় কলেজের সহকারী অধ্যাপক মুর্শেদ আলম বলেন-বাতির নিচে অন্ধকারের মতো কোম্পানীগঞ্জ, চাঁনপুর গ্রাম এক অবহেলিত জনপদ। নদী ভাঙন এবং ঢলে বিলীন হতে হতে একদিন এ জনপদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। প্রাচীন এ জনপদ রক্ষা এবং এখনকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনই এখন সময়ের দাবি। বন্যার ঢল থামলেও চাঁনপুর গ্রামের ভেতর ও বাইর এখনো অথৈ জলে ভাসছে।
মানবজমিন