সিলেটে বন্যার সেই রাত : প্রসব বেদনায় ছটফট, মেয়েটি বললো আমি বাঁচবো না
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:০০:২৭,অপরাহ্ন ০২ জুলাই ২০২২
ওয়েছ খছরুঃ
‘সুমন মিয়ার মেয়ে। যখন প্রসব ব্যথা উঠেছে, তখন ঘরে হাঁটু পানি। মেয়েটা বলছে- মাগো আমি আর বাঁচবো না। তোমরা আমাকে বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। তখন বাবাসহ ৪-৫ জন মিলে ঘরে একটা পালঙ্কের উপর পালঙ্ক তোলে। যখন দুই নাম্বার পালঙ্কের উপর প্রসূতিকে তোলা হলো এর কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটা কন্যা সন্তান জন্ম দেয়। এরইমধ্যে ঘরে বাঁশ দিয়ে মাচা বান্ধা শেষ হয়েছে। আল্লাহ রহমত করেছে। তিনদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাদের ওসমানী হাসপাতালে পাঠাই। এখন তারা ভালো আছে।’ কথাগুলো বলছিলেন হাসিনা আক্তার।
সিলেট সদরের দুর্গম কামাউড়াকান্দি এলাকার বাসিন্দা তিনি। একজন রাজনীতিবিদ। সদর উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। গতকাল একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে তার এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। সঙ্গে ছিলেন উপ-পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ। তখন সাংবাদিকদের কাছে বন্যা হানা দেয়ার প্রথম রাতের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেন তিনি। তার বাড়িও ওই এলাকায়। ভয়াবহ সেই দৃশ্য। বর্ণনা করতে গিয়ে আঁতকে ওঠেন হাসিনা আক্তার।
রাতে নিজে যেভাবে উদ্ধার হয়েছিলেন সেটিও জানালেন। বেঁচে আছেন বলে শুকরিয়া জানালেন আল্লাহর দরবারে। হাসিনা আক্তার জানালেন, ‘আমি একাত্তরের যুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু এবারের বন্যা দেখেছি। বন্যার সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করেছি। কীভাবে যুদ্ধ করেছি, আমরা বাচ্চাগুলোকে কীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে নেবো এবং যেগুলো তলিয়ে গেছে- কীভাবে আমরা তাদের উদ্ধার করবো?’ ১৬ই জুন এবার সিলেটে দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত হানে বন্যা। ঘটনাস্থল কামাউড়াকান্দিতে দাঁড়িয়ে ওই ভীবিষিকাময় রাতের বর্ণনা দিয়ে হাসিনা আক্তার জানান, ‘এই সাগরটা পাড়ি দিয়ে ওই দামাটিলা জায়গায় আমরা মানুষজনকে নিয়ে গেছি। সেখানে নিয়ে গিয়েও তারা খাদ্যের অভাব বোধ করছে। যখন বাড়ির জানালা দিয়ে পানি ঢোকা শুরু করছে। যখন ঘরবাড়ি ভেসে যাচ্ছে। শিশুকে মা কোলে নিয়ে যখন হাঁটছে। এক শিশু হাতে। আরেক শিশু কোলে। হাতের শিশুটা পানিতে পড়ে গেছে; তখন ওই শিশুটাকে উদ্ধারের জন্য মানুষ পাওয়া যায়নি। মা-ই উদ্ধার করেছে। আমরা অনেক মানুষ দেখেছি অসহায়। কে কাকে তখন সাহায্য করবে। তখন আমরা খুব অসহায়ত্বের মধ্যে ছিলাম। নৌকার জন্য ‘বাবা-বাবা’ বলে ডাকা হয়েছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাড়ির ছাদে কিংবা চালের উপর উঠে মানুষকে ডাকা হয়েছে।
তোমরা আমাদের বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও।’ হাসিনা জানান, ‘রাত যখন একটা বাজে তখন একটা নৌকা আসে গরু নিয়ে। ওই নৌকাতে তোলা হয়েছে মানুষ। আমাদের পরিবারসহ কয়েকটি পরিবারের মানুষ। নৌকায় ওঠার পর আমাদের কামারটিলা নামের একটি জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছে। সেই জায়গায় ছিল কোমরপানি। এই কোমরপানি ভেঙে আমরা হাঁটতে হাঁটতে নালিয়া পয়েন্টে গিয়ে পৌঁছি। তখন রাত দুইটা। নালিয়া পয়েন্টে গিয়ে আমরা গাড়ির গ্যারেজে আওয়াজ করছি। আমাদের শব্দ শুনে দুইজন ড্রাইভার আসে। আমাদের অবস্থা দেখে ওরা ৫টি সিএনজি নিয়ে আমাদেরকে শহরের আখালিয়ার রাস্তার উপর নামিয়ে দিয়ে চলে আসে।’ রাতের ভয়াবহ বর্ণনার পরের দিনের কথা স্মরণ করে হাসিনা জানান, ‘পরের দিন আমরা এসে দেখি এলাকার একটা বাড়িতেও মানুষ নেই। কই গেছে, কীভাবে গেছে- নেট নেই, মোবাইল নেই, আলোও নেই। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আমরা নৌকা নিয়ে খোঁজ শুরু করি। গিয়ে দেখি বাইশটিলা আশ্রয়কেন্দ্র উঠছে কিছু মানুষ, দামাটিলা প্রাইমারি স্কুলে উঠছে মানষ। মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মেরিন একাডেমিতে উঠছে এলাকার মানুষ।
এভাবে মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে গেছে।’ হাসিনা জানিয়েছেন, ‘আত্মসম্মানের বোধ না রেখে পানিবন্দি মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য বাড়িঘর, সহায় সম্পদ সবটুকু ফেলে তারা চলে গেছেন। ৪ দিন এভাবে কেটেছে সবার। এরপর যখন পানি নামলো তখন মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর জায়গায় জায়গায় গিয়ে খোঁজ করে লোকজনকে বাড়িঘরে আনা হয়েছে। এখানে স্টিলের নৌকা আছে কয়েকটা। একটা নৌকার মধ্যে ১০টা পরিবার উঠেছে। এই নৌকার মধ্যে কীভাবে তারা বাথরুম করবে, কীভাবে তারা বাচ্চাগুলোকে খাবার দেবে- হাহাকার অবস্থায় তারা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছে।’ বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে হাসিনা জানান, ‘এখনো মানুষ চিড়া মুড়ি খাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ আসছে; সকলকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে।’