বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সিলেটে বারবার বন্যার কারণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জুন ২০২২, ১২:৫৪ অপরাহ্ণ
রাতের আলোর উজ্জ্বলতা বিশ্লেষণ করে বন্যার প্রবণতা বোঝার এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে গত ২০ বছরে বন্যার ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।
বিবিসি বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত এ গবেষণার বিবরণ অনুযায়ী, বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্যাটেলাইট থেকে তোলা রাতের ছবি বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখেছেন, নদ-নদীর অববাহিকা এবং প্লাবনভূমিতে জনবসতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যার পানি সঞ্চিত হওয়ার স্থান এভাবে ভরে যাওয়ায় বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে এই গবেষণাটি করেছেন।
গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইটের তোলা রাতের ছবির ভিত্তিতে। রাতে স্থলভাগে যে আলোর মাত্রা দেখা যায়, তা থেকে দেশের কোথায় কোথায় জনবসতি রয়েছে তা বোঝা যায়। গত দুই দশকের এই আলোর ছবি বিশ্লেষণ করে এ সময় কিভাবে প্লাবনভূমিতে ঘরবাড়ি, সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গত দুই দশকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে রাতের উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আর বর্তমানে দেশের এই এলাকাই স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ মানুষ সরাসরি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। তারা নদ-নদীর দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বসবাস করে। আর ঘন ঘন বন্যা বা অতিবন্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় এবারের ভয়াবহ বন্যার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ত্রিদেশীয় এই গবেষণাটি বলছে, হাওর এলাকায় নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায় নাসার একাধিক স্যাটেলাইট থেকে তোলা বাংলাদেশের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে দুইবার করে এসব ছবি তোলা হয়। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা কোথায় কোথায় আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমে বেড়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা পেয়েছেন।
গবেষণাদলের প্রধান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রাতের আলো থেকে আমরা মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের একটা চিত্র পেতে পারি। কোথায় উজ্জ্বলতা বেশি, কোথায় কম, কেন বেশি, কেন কম—এসব বিশ্লেষণ করে আমরা মানুষের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ধারণা পেতে পারি। সেটা হতে পারে বসতবাড়ি, কলকারখানা অথবা নানা ধরনের অবকাঠামো। ’
গবেষণাটিতে স্যাটেলাইট থেকে তোলা রাতের আলোর চিত্রের পাশাপাশি ভৌগোলিক তথ্য, ভূমির ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যার বণ্টন, বিদ্যুতের সরবরাহ ইত্যাদি তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দেশে বড় বড় নগর, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, যশোর, খুলনা এসব শহরের প্লাবনভূমিগুলো গত ২০ বছরে অনেকাংশে মানুষের দখলে চলে গেছে।
এ ছাড়া ছোট-বড় নদীগুলোর অববাহিকা, অর্থাৎ দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে মানুষের উপস্থিতির হার বহুলাংশে বেড়েছে। গবেষকরা বলছেন, সিলেট অঞ্চলের বর্তমান নজিরবিহীন বন্যার পেছনেও বড় কারণ প্লাবনভূমি এবং হাওরের ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ।
স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলে রাতের উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সারা দেশেই আলোর মাত্রা বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সিলেট বিভাগে। সেখানে রাতের আলোর উজ্জ্বলতা প্রায় ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ গবেষণা থেকে তাঁদের উপলব্ধি ও পরামর্শ সম্পর্কে কালের কণ্ঠ জানতে চেয়েছিল গবেষকদলের অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব মুর্শেদের কাছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, জনবসতি প্লাবনভূমির বাইরে থাকা নিরাপদ। বর্ষায় প্লাবিত হওয়া এসব অঞ্চল বাড়তি পানি ধরে রাখার জায়গা।
অধ্যাপক মাহবুব মুর্শেদ বলেন, বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল বিশ্বেরই সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চলের অদূরে। সেখানে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট গড়ে উঠেছে। এতে পানি জমা হওয়ার জায়গা কমে গেছে। এর সহজ সমাধান হচ্ছে হাওর ও প্লাবনভূমিতে নির্বিচার নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করা যাবে না। সড়কের পরিমাণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াকে তিনি বৃহত্তর সিলেটের এবারের বন্যায় নৌকার অপ্রতুলতার কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। অধ্যাপক মাহবুব মুর্শেদের মতে, এটি এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
এই গবেষণায় আরো যুক্ত ছিলেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. আরিফ মাসরুর।
সূত্র: বিবিসি বাংলা