জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে আসা মহিষ নিয়ে তুলকালাম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২১:৩৩,অপরাহ্ন ০২ জুন ২০২২
ওয়েছ খছরুঃ
বুধবার সকাল ১০টা। স্পট; জৈন্তাপুরের সারিঘাট। সড়কে ব্যারিকেড। ট্রাক শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ। বিজিবি সদস্যরাও আছেন ওখানে। একটি পিকআপে তিনটি মহিষ। শ্রমিকরা দাবি করছে; এই মহিষ তিনটির রসিদ আছে। বিজিবি বলছে; এগুলো চোরাচালানের মহিষ। ছাড়া যাবে না। দু’পক্ষ অনড়।
সড়ক বন্ধ। খবর পেয়ে ছুটে এলেন জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর। তার আশ্বাসে শ্রমিকরা ব্যারিকেড তুললেন। এক ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিজিবিও সরে যায় ওখান থেকে। গত সোমবার সন্ধ্যারাত। স্পট; জৈন্তাপুর বাজার। দুটি পিকআপে ৮টি মহিষ। বিজিবি সদস্যরা ট্রাক দুটি আটক করতে চাইলেন। ব্যবসায়ীরা বাধা দিলেন। এ নিয়ে টানাহেঁচড়া। খবর শুনে রাজবাড়ী ক্যাম্প থেকে ছুটে আসেন বিজিবির সদস্যরা। লাঠিপেটা করেন বাধা দানকারী ব্যক্তিদের। লাঠিপেটার ১৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিও নিয়ে এখন জৈন্তাপুরে তোলপাড়। শুধু এ ঘটনাই নয়, এর আগে শ্রীপুর ক্যাম্প ও লালাখাল ক্যাম্পের বিজিবি’র সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয়দের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। শ্রীপুর ক্যাম্পে মহিষ আটকের ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ বাধে বিজিবি’র। আর রমজানের আগে দরবস্তের গরু আটকের ঘটনায় বিজিবি ও এলাকাবাসী মুখোমুখি ছিলেন। ওই সময়ও রাস্তায় ব্যারিকেড হয়েছিল। পরে বিজিবির মামলায় আসামি করা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বাহারকে। ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা জৈন্তাপুর। বলা হয়ে থাকে; চোরাচালানের অন্যতম রুট এটি। বেশি আসে মহিষ ও গরু। চোরাকারবারিরাও সক্রিয়। সীমান্তের অদূরবর্তী স্থানেই পশুর হাটে। বিজিবির নজর এগিয়ে হাটে তুলতে পারলেই বৈধ হয়ে যায় এসব পশু। কিন্তু বিজিবি জওয়ানরাও নাছোড়বান্দা। সীমান্তে ধরতে না পারলেও রাস্তায় এসে অভিযানে নামছেন। এতে করে চোরাকারবারিরা ব্যবহার করছে এলাকার লোকজন। প্রতিটি ঘটনায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ান এলাকার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ; বিজিবি বাড়াবাড়ি করছে। চিহ্নিত চোরাকারবারিদের আটক করছে না। আর পশু বহনকারী পিকআপ ও চালকের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মামলা, গ্রেপ্তার সবই হচ্ছে পিকআপ চালকদের ওপর। তাদের মতে; বিজিবি’র কাজ হবে সীমান্তে। তা না করে তারা এসে অভিযান চালাচ্ছেন বাংলাদেশের কয়েক কিলোমিটার অভ্যন্তরে। কখনো সড়কে, কখনো বাজারে। এজন্য বিজিবির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ রাস্তার ব্যারিকেডে নেমেছে।
জৈন্তাপুরের রাজবাড়ী বিজিবি ক্যাম্পের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন- গতকাল সকালে ডিবির হাওর এলাকা দিয়ে ভারত থেকে তিনটি মহিষ ভিন্ন পন্থায় বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলো কানাইঘাটের এক চোরাকারবারি। ওই তিনটি মহিষ ডিবির হাওরের ১২৮৫ নং পিলারের কাছ দিয়ে পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর এগুলো জৈন্তাপুর দিয়ে না এনে নদীপথে সারিঘাটে নিয়ে আসা হয়েছে। সারিঘাট এলাকা থেকে ওই মহিষগুলো পিকআপে তুলে যখন সিলেট অভিমুখে রওয়ানা দেয় তখন চালকের চোখে পড়ে মোটরসাইকেলে টহলে থাকা বিজিবি’র দলকে। দ্রুত এলাকা ত্যাগ করতে গিয়ে মহিষ বহনকারী ওই পিকআপ পাথরবোঝাই একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এ সময় বিজিবি জওয়ানরা গিয়ে ওই পিকআপ আটক করেন। প্রথমে চালক মহিষগুলো ভারত থেকে এসেছে বলে স্বীকার করলেও কিছু সময় পর পরিবহন শ্রমিকদের কয়েকজন নেতা গিয়ে এই মহিষগুলো স্থানীয় এক খামারির বলে দাবি করেন। এ সময় তারা জৈন্তাপুর বাজারের একটি রশিদও প্রদর্শন করেন। অভিযানের থাকা বিজিবি’র সদস্যরা মহিষগুলো ভারতীয় দাবি করে পিকআপসহ ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইলে শ্রমিকরা বাধা দেন। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় সারিঘাটের স্থানীয় লোকজনও। পরিবহন শ্রমিকরা বিজিবি’র অভিযানের বিরোধিতা করে সকাল ১০টার দিকে সারিঘাট এলাকায় সিলেট-তামাবিল সড়ক অবরোধ করেন। এতে করে ওই সড়কে ব্যারিকেড স্থলে উভয়পাশে হাজারো যানবাহন আটকা পড়ে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- খবর পেয়ে জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর আহমেদ আসেন সারিঘাটে। তিনি এসে তার জিম্মায় মহিষগুলো নেন। এবং ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিলে স্থানীয়রা ব্যারিকেড তুলে নেয়।
জৈন্তাপুর থানার ওসি জানিয়েছেন- ‘বিষয়টি নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এরপর তারা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব আমার ওপর দিলে আমি কাগজপত্র পর্যালোচনার পর মহিষগুলো মালিকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছি।’ তিনি বলেন- ‘তিনটি মহিষের রশিদ ছিল জৈন্তাপুর বাজারের। এ কারণে মহিষগুলোর বৈধতা পাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
সারিঘাট এলাকার ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আশিকুর রহমান দাবি করেছেন- ‘ওই মহিষগুলো বৈধ ছিল। রশিদ সহকারে জৈন্তাপুর বাজার থেকে সিলেট অভিমুখে নিয়ে আসা হচ্ছিলো। বৈধ কাগজপত্র প্রদর্শনের পর মহিষগুলো না ছাড়ার কারণে স্থানীয়রা রাস্তা ব্যারিকেড দিয়েছে। পুলিশের আশ্বাসে পরে আমরা ব্যারিকেড তুলে নেই।’ তিনি জানান- ‘মহিষ যদি সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসে তাহলে বিজিবি সেগুলো সীমান্তে আটক করলে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতো না। কিন্তু সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে এসে অভিযান চালিয়ে মহিষ আটক করায় এ ঘটনা ঘটে।’ ওদিকে বিজিবির লাঠিপেটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই জৈন্তাপুরে বিজিবি’র কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতিবাদও জানাচ্ছেন অনেকেই।
কেন ঘটেছে এমন ঘটনা- প্রশ্ন করা হলে জৈন্তাপুরের রাজবাড়ী বিজিবি বিওপির কমান্ডার আব্দুর রহিম জানিয়েছেন- বিজিবি ওইদিন পিটিয়েছে সত্য। চোরাকারবারিদের শায়েস্তা করতে গিয়ে অনেক নিরীহ মানুষের ওপর লাঠিপেটা হয়েছে। এ ঘটনার আগে চোরাকারবারি নাজিমের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন লোক হামলা চালিয়ে বিজিবি সদস্যদের আহত করে। পরে চোরাকারবারিদের ধরতে ওখানে বিজিবি’র দুটি টিম গিয়েছিল। বিজিবি বিওপি কমান্ডার দাবি করেন- গত সোমবার সন্ধ্যার দিকে দুটি পিকআপে করে স্থানীয় গোয়াবাড়ি সীমান্ত দিয়ে চোরাকারবারিরা ৮টি মহিষ জৈন্তাপুরে নিয়ে আসে। বাজারের ঢোকার মুহূর্তে সিলেট-তামাবিল সড়কে বিজিবি’র জওয়ানরা ওই দুটি ট্রাকে থাকা মহিষ জব্দ করতে চাইলে চোরাকারবারিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজিবি’র সদস্যদের ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে তারা জোরপূর্বক ওই মহিষগুলো পশুর হাটে নিয়ে যায়। এ ঘটনার খবর শুনে রাজবাড়ী বিওপির সদস্যরা গিয়ে লাঠিচার্জ করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা।
তারা জানিয়েছেন- বিজিবি’র সদস্যরা সাদা পোশাকে এসেছিলো। তারা বাজারের মধ্যে এসে মহিষ চোরাচালানের দাবি করে ব্যবসায়ীদের ধমকাচ্ছিলো। এ সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। কিন্তু এর জের ধরে এসে বিজিবি জৈন্তাপুর বাজারে যেভাবে লাঠিপেটা করেছে সেটা নজিরবিহীন।