৭০৪ বছর ধরে যে উৎসব পালন হচ্ছে সিলেটে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২২, ৩:০৬ অপরাহ্ণ
ওয়েছ খছরুঃ
লাকড়ি তোড়া উৎসব। সিলেটের আদি সংস্কৃতি। সিলেটের অন্যতম এ উৎসব। ৭০৪ বছর ধরে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। বর্ণিল এ আয়োজনে সিলেট মেতে উঠে ভিন্ন সাজে।
বিশেষ করে চায়ের বাগান লাক্কাতোড়া থেকে দলবেঁধে লাকড়ি নিয়ে আসা হয়। আর ওই লাকড়ি স্তূপ করে রাখা হয় ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে। ওরসে শিরনি রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় এই লাকড়ি। তবে- চারটি কারণে সিলেটে শত শত বছর ধরে এই উৎসব পালন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ মাজার ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আলহাজ শেখ মকন মিয়া জানিয়েছেন- লাকড়ি তোড়া উৎসবের দিনকে সিলেট বিজয় দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। ওই দিন হযরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ আউলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটে এসে তখনকার রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে সিলেট জয় করেন।
এ কারণে এই দিনকে সিলেট বিজয় দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ দিন হযরত শাহজালাল (রহ.) মারা যান। এ কারণে এ দিনে বিশেষ প্রার্থনাও করা হয়। দুইজন কাঠুরিয়ার মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো। লাক্কাতোড়া বাগান থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসার পর দরগাহে বসে বর নির্ধারণ ও বিয়ে দেয়া হয়। কাঠ কাটারার মাধ্যমে কাঠুরিয়ার জীবনের কষ্টের বিষয়ও তুলে ধরা হয় এই উৎসবে। এ কারণে প্রতি বছর এ দিনকে লাকড়ি তোড়া ওরস কিংবা লাকড়ি তোড়া উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।
এদিকে- লাকড়ি তোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে গতকাল হাজার হাজার ভক্ত ও আশেকানের ঢল নেমেছিল সিলেট নগরে। সকাল থেকে ট্রাকযোগে গান বাজিয়ে ভক্তরা মিছিল সহ আসেন মাজার প্রাঙ্গণে। দুপুর গড়াতেই মাজার এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। নেচে গেয়ে সিলেট বিজয়ের এই দিনকে পালন করেন ভক্তরা। তবে মাজার কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে সব কর্মসূচি পালন করেছেন। বাদ জোহর মাজারের প্রধান ফটকের সামনে মোনাজাতের মাধ্যমে উৎসবের শুরু করা হয়। এরপর সবাই দলবেঁধে কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী এলাকা লাক্কাতোড়ায় যান। সেখানে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হয়। এরপর উপস্থিত সকলের মাঝে শিরনি বিতরণ করা হয়। সবাই লাক্কাতোড়া বাগান থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে ফের মিছিল সহকারে মাজার প্রাঙ্গণে আসেন। মাজারের খাদেম সামুন মাহমুদ খান জানিয়েছেন, হযরত শাহজালাল (রহ.) ওরসের আগে এই লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করা হয়। ভক্ত ও আশেকানরা যে লাকড়ি নিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে আসেন সেগুলো সংরক্ষিত করে রাখা হয়। এরপর এই লাকড়ি ওরসের শিরনির তৈরি কাজে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া, লাকড়ি তোড়া ওরসকে কেন্দ্র করে খতমে কোরআন, মিলাদ ও বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এদিকে- লাকড়ি তোড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত ও আশেকানরা আসেন ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে। সকাল থেকে তারা মাজারের উঠোন, পুকুরের পাড়, ঝরনার পাড় এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় সবার মাথায় থাকে লাল কাপড় বাঁধা। কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচগানও করেন। ভক্তি ও আশেকানি গানে সকাল থেকে মুখরিত হয়ে উঠে মাজার এলাকা। লাকড়ি নিয়ে আসার পরও গান চলে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মুরারবন্দ থেকে এসেছিলেন হযরত সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার খাদেম গিয়াসউদ্দিন পীর নজরুল আহমদ চিশতি। তিনি জানিয়েছেন, ৭০৪ বছর ধরে সিলেটে লাকড়ি তোড়া উৎসব পালন করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি দলবল নিয়ে এই উৎসবে শরিক হন। গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে স্বল্প পরিসরে উৎসব পালন হয়। এবার মুক্ত পরিবেশে ওরস হওয়ায় ভক্তদের ঢল নেমেছে। তিনি বলেন, এই উৎসবের মহাত্ম অনেক। হযরত শাহজালাল (রহ.) স্মৃতিবিজড়িত এই উৎসবে সবাই অংশ গ্রহণ করেছে। দেশের দূর-দূরান্ত থেকেও ভক্তরা এসেছেন।
হযরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ আউলিয়া ভক্তবৃন্দ পরিষদের দক্ষিণ সুরমার সভাপতি হাজী শাহ হারুন অর চিশতি জানিয়েছেন, সিলেট বিজয়ের এই দিনে আলোকিত হয়েছিল এ জনপদ। সূদূর ইয়ামিন থেকে ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে সিলেট এসে আসন গেড়েছিলেন শাহজালাল (রহ.)। ফলে এই দিনটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এই দিন থেকে আমরা মূল ওরসের প্রস্তুতি শুরু করি।
এদিকে- এবার উৎসবে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি থাকার কারণে বিকাল পর্যন্ত লাকড়ি সংগ্রহ করা হয়। কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে আবার কেউ কেউ দলবেঁধে গিয়ে লাকড়ি সংগ্রহ করেন। উৎসব উপলক্ষে ভক্ত আশেকানের ঢল নামার কারণে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকা থেকে লাক্কাতোড়া বাগান পর্যন্ত বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়।